
আজ ফলাফলের মধ্য দিয়ে দেশের চারটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন শেষ হলো। ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। অন্যদিকে, আশানুরূপ ফল তো দূরের কথা, একটি কেন্দ্রেও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীরা। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছাত্রদলের জন্য এক প্রকার ‘ভূমিধস পরাজয়’।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সূচনা হয়। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। চলতি মাসে ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) এবং ১৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন।
এসব নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। তবে প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (ছাত্রদল) সমর্থিত প্যানেলগুলো।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, এবারের নির্বাচনগুলোতে প্রচারণা ছিল তুলনামূলকভাবে সুষ্ঠু ও কৌশলভিত্তিক। প্রার্থীরা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অধিক উন্মুক্তভাবে প্রচার চালাতে পেরেছেন। ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রে ছিল না পূর্বের মতো বাধা বা সীমাবদ্ধতা। ফলে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সহজ হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলগুলো অভিযোগ করেছে, তাদের প্রচারণায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব ছিল। প্রচার কৌশল কী হবে এবং তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে ছিল দ্বিধা ও সমন্বয়ের ঘাটতি। নেতৃত্ব সংকট এবং মাঠপর্যায়ে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধও প্রার্থীদের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে অনেকের মত।
ডাকসুর ফলাফল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অতীতে কখনো এত বড় জয়ের দেখা পায়নি ইসলামী ছাত্রশিবির। ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জয়ী হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনটি।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে সহসভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান পান ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। তুলনামূলকভাবে অনেক কম ভোট পাওয়ায় তাকে বড় ধরনের পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়।
একই ধারা দেখা গেছে জিএস পদের ফলাফলেও। ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী এস এম ফরহাদ ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল জোটের প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম প্রায় অর্ধেক ভোট পেয়ে পরাজিত হন।
এজিএস পদেও ছাত্রশিবির জোটের মুহা. মহিউদ্দীন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। ছাত্রদল জোটের তানভীর আল হাদী মায়েদ ৫ হাজার ৬৪ ভোট পেয়ে হেরে যান।
জাকসুর ফলাফল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু)-এর ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালের শেষ তিনটি নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পেয়েছিল ছাত্রদল। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আয়োজিত জাকসু নির্বাচনে সেই পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা করেছিল ছাত্রদলের কর্মী-সমর্থকেরা। তবে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল ভরাডুবির মুখে পড়ে।
২৫টি পদের মধ্যে একটি পদেও জয়ী হতে পারেনি ছাত্রদলের প্রার্থীরা। বিপরীতে, ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থীরা ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতে জয় অর্জন করেছে।
জাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে ৩ হাজার ৩৩৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্যানেলের আবদুর রশিদ (জিতু)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রশিবির জোটের আরিফ উল্লাহ ২ হাজার ৩৯২ ভোট পান।
এ নির্বাচনে ছাত্রদল জোটের প্রার্থী শেখ সাদী হাসান নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেন এবং ৬৪৮ ভোট পান।
জিএস, এজিএসসহ মোট ২০টি পদে বিপুল ভোটে জয় পায় ছাত্রশিবির সমর্থিত জোট। প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় ছাত্রদলের ভরাডুবি ঘটে।
চাকসুর ফলাফল
দীর্ঘ ৪৪ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)-এর নেতৃত্বে ফিরে এসেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির সমর্থিত জোটের প্রার্থীরা ভিপি ও জিএসসহ ২৪টি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। আশানুরূপ ভোট না পাওয়ায় এ বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন।
ভিপি পদে ছাত্রশিবিরের মো. ইব্রাহিম হোসেন ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, ছাত্রদল প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট পেয়ে হেরেছেন।
জিএস পদে একই প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মো. শাফায়াত ২ হাজার ৭৩৪ ভোট পেয়ে হেরেছেন।
এজিএস পদে ছাত্রশিবিরের সাজ্জাদ হোসেন ৫ হাজার ৪৫ ভোট পেলেও এ পদে জয় পান ছাত্রদল জোটের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক, যিনি ৭ হাজার ১৪ ভোট পান।
রাকসুর ফলাফল
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল আজ সকালে ঘোষণা হয়েছে। ঘোষণার পরপরই শুরু হয় উল্লাস আর স্লোগান। কেননা, নির্বাচনে ২৩টি পদের মধ্যে ২০টিতেই নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে ছাত্রশিবির জোট। শুধু তিনটি পদ সাধারণ সম্পাদক (জিএস), ক্রীড়া সম্পাদক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক জোটের হাতছাড়া হয়েছে।
ভিপি পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, জিএস পদে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের সালাউদ্দিন আম্মার, এবং এজিএস পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের এস এম সালমান সাব্বিরের নাম ঘোষণা করা হয়।
ভিপি পদে ১২ হাজার ৬৮৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। একই পদে নিকটতম ছাত্রদল জোটের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন (আবীর) ৩ হাজার ৩৯৭ পেয়ে হেরেছেন।
এদিকে জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের সালাউদ্দিন আম্মার বড় ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মোট ভোট পেয়েছেন ১১ হাজার ৪৯৭টি। তার নিকটতম শিবিরের প্যানেলের জিএস প্রার্থী ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৭ ভোট।
এজিএস পদে ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী এস এম সালমান সাব্বির নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ভোট পেয়েছেন ৬ হাজার ৯৭৫টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্রদল জোটের জাহিন বিশ্বাস (এষা) ৫ হাজার ৯৫১ ভোট পেয়ে হেরেছেন।
ছাত্রদলের কেন এই ভরাডুবি
ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসুর সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ছাত্রদলের ভরাডুবি একাধিক মাত্রায় রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, নেতৃত্বের দুর্বলতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, প্রচারণার ঘাটতি এবং ভোটারদের সঙ্গে দূরত্ব—এই চারটি প্রধান কারণ ছাত্রদলের এই ব্যর্থতার পেছনে কাজ করেছে।
প্রথমত, ছাত্রদলের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতার অভাব ও সময়োপযোগী দিকনির্দেশনার ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। তারা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, নির্বাচনি কৌশলেও ছিল দুর্বলতা। এমনকি প্রার্থী মনোনয়নের সময়ও অনেক নেতা জানতেন না কারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নেতৃত্বের এই অনিশ্চয়তা ও অদক্ষতা ছাত্র সংগঠনটিকে আরও পিছিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, মাঠপর্যায়ে ছাত্রদলের কর্মীসংখ্যা কমে গেছে, ক্যাম্পাসে সংগঠনের উপস্থিতিও দুর্বল। বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং হলভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা কার্যকর প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ফলে সংগঠনটি নির্বাচনের জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল।
তৃতীয়ত, প্রচারণার দিক থেকে ছাত্রদল ছিল একেবারে পিছিয়ে। অন্য সংগঠনগুলো যেখানে সোশ্যাল মিডিয়াসহ আধুনিক কৌশলে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে, সেখানে ছাত্রদল ছিল নিষ্ক্রিয়। শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করার মতো নতুনত্ব বা চমক কিছুই তারা উপস্থাপন করতে পারেনি। প্রচারণার ঘাটতি ভোটারদের কাছে দলটির বার্তা পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়।
চতুর্থত, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে। অনেকে এখন দলনিরপেক্ষ ও কার্যকর ছাত্ররাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। ছাত্রদল একটি দায়িত্বশীল, বিশ্বাসযোগ্য ছাত্রসংগঠনের ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি, লুটপাটসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগও ছাত্রদলের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মতে, ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে উপস্থিতি ছিল খুবই সীমিত। তাদের কর্মসূচি দুর্বল ও সংগঠন এখনো অগোছালো। এমনকি ছাত্রলীগ নিষ্ক্রিয় থাকা অবস্থাতেও তারা নিজেদের শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে পারেনি। বিপরীতে, শিবির অনেক আগে থেকেই প্রার্থী ঠিক করে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছে। তারা বছরের শুরু থেকেই ক্যাম্পেইন করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছে, এর ফলে তারা সাফল্যও অর্জন করতে পেরেছে।
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমানের মতে, জামায়াত যেভাবে তাদের ছাত্রসংগঠনকে সমর্থন দিয়েছে, বিএনপি তেমনভাবে ছাত্রদলের পেছনে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
ডাকসু-জাকসু-চাকসু-রাকসুতে ছাত্রদলের ভরা ডুবির কারণ কি ?
আজ ফলাফলের মধ্য দিয়ে দেশের চারটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন শেষ হলো। ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। অন্যদিকে, আশানুরূপ ফল তো দূরের কথা, একটি কেন্দ্রেও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীরা। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছাত্রদলের জন্য এক প্রকার ‘ভূমিধস পরাজয়’।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সূচনা হয়। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। চলতি মাসে ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) এবং ১৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন।
এসব নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। তবে প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (ছাত্রদল) সমর্থিত প্যানেলগুলো।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, এবারের নির্বাচনগুলোতে প্রচারণা ছিল তুলনামূলকভাবে সুষ্ঠু ও কৌশলভিত্তিক। প্রার্থীরা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অধিক উন্মুক্তভাবে প্রচার চালাতে পেরেছেন। ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রে ছিল না পূর্বের মতো বাধা বা সীমাবদ্ধতা। ফলে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সহজ হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলগুলো অভিযোগ করেছে, তাদের প্রচারণায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব ছিল। প্রচার কৌশল কী হবে এবং তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে ছিল দ্বিধা ও সমন্বয়ের ঘাটতি। নেতৃত্ব সংকট এবং মাঠপর্যায়ে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধও প্রার্থীদের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে অনেকের মত।
ডাকসুর ফলাফল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অতীতে কখনো এত বড় জয়ের দেখা পায়নি ইসলামী ছাত্রশিবির। ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জয়ী হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনটি।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে সহসভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান পান ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। তুলনামূলকভাবে অনেক কম ভোট পাওয়ায় তাকে বড় ধরনের পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়।
একই ধারা দেখা গেছে জিএস পদের ফলাফলেও। ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী এস এম ফরহাদ ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল জোটের প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম প্রায় অর্ধেক ভোট পেয়ে পরাজিত হন।
এজিএস পদেও ছাত্রশিবির জোটের মুহা. মহিউদ্দীন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। ছাত্রদল জোটের তানভীর আল হাদী মায়েদ ৫ হাজার ৬৪ ভোট পেয়ে হেরে যান।
জাকসুর ফলাফল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু)-এর ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালের শেষ তিনটি নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পেয়েছিল ছাত্রদল। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আয়োজিত জাকসু নির্বাচনে সেই পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা করেছিল ছাত্রদলের কর্মী-সমর্থকেরা। তবে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল ভরাডুবির মুখে পড়ে।
২৫টি পদের মধ্যে একটি পদেও জয়ী হতে পারেনি ছাত্রদলের প্রার্থীরা। বিপরীতে, ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থীরা ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতে জয় অর্জন করেছে।
জাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে ৩ হাজার ৩৩৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্যানেলের আবদুর রশিদ (জিতু)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রশিবির জোটের আরিফ উল্লাহ ২ হাজার ৩৯২ ভোট পান।
এ নির্বাচনে ছাত্রদল জোটের প্রার্থী শেখ সাদী হাসান নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেন এবং ৬৪৮ ভোট পান।
জিএস, এজিএসসহ মোট ২০টি পদে বিপুল ভোটে জয় পায় ছাত্রশিবির সমর্থিত জোট। প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় ছাত্রদলের ভরাডুবি ঘটে।
চাকসুর ফলাফল
দীর্ঘ ৪৪ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)-এর নেতৃত্বে ফিরে এসেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির সমর্থিত জোটের প্রার্থীরা ভিপি ও জিএসসহ ২৪টি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। আশানুরূপ ভোট না পাওয়ায় এ বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন।
ভিপি পদে ছাত্রশিবিরের মো. ইব্রাহিম হোসেন ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, ছাত্রদল প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট পেয়ে হেরেছেন।
জিএস পদে একই প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মো. শাফায়াত ২ হাজার ৭৩৪ ভোট পেয়ে হেরেছেন।
এজিএস পদে ছাত্রশিবিরের সাজ্জাদ হোসেন ৫ হাজার ৪৫ ভোট পেলেও এ পদে জয় পান ছাত্রদল জোটের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক, যিনি ৭ হাজার ১৪ ভোট পান।
রাকসুর ফলাফল
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল আজ সকালে ঘোষণা হয়েছে। ঘোষণার পরপরই শুরু হয় উল্লাস আর স্লোগান। কেননা, নির্বাচনে ২৩টি পদের মধ্যে ২০টিতেই নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে ছাত্রশিবির জোট। শুধু তিনটি পদ সাধারণ সম্পাদক (জিএস), ক্রীড়া সম্পাদক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক জোটের হাতছাড়া হয়েছে।
ভিপি পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, জিএস পদে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের সালাউদ্দিন আম্মার, এবং এজিএস পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের এস এম সালমান সাব্বিরের নাম ঘোষণা করা হয়।
ভিপি পদে ১২ হাজার ৬৮৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। একই পদে নিকটতম ছাত্রদল জোটের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন (আবীর) ৩ হাজার ৩৯৭ পেয়ে হেরেছেন।
এদিকে জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের সালাউদ্দিন আম্মার বড় ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মোট ভোট পেয়েছেন ১১ হাজার ৪৯৭টি। তার নিকটতম শিবিরের প্যানেলের জিএস প্রার্থী ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৭ ভোট।
এজিএস পদে ছাত্রশিবির জোটের প্রার্থী এস এম সালমান সাব্বির নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ভোট পেয়েছেন ৬ হাজার ৯৭৫টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্রদল জোটের জাহিন বিশ্বাস (এষা) ৫ হাজার ৯৫১ ভোট পেয়ে হেরেছেন।
ছাত্রদলের কেন এই ভরাডুবি
ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসুর সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ছাত্রদলের ভরাডুবি একাধিক মাত্রায় রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, নেতৃত্বের দুর্বলতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, প্রচারণার ঘাটতি এবং ভোটারদের সঙ্গে দূরত্ব—এই চারটি প্রধান কারণ ছাত্রদলের এই ব্যর্থতার পেছনে কাজ করেছে।
প্রথমত, ছাত্রদলের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতার অভাব ও সময়োপযোগী দিকনির্দেশনার ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। তারা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, নির্বাচনি কৌশলেও ছিল দুর্বলতা। এমনকি প্রার্থী মনোনয়নের সময়ও অনেক নেতা জানতেন না কারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নেতৃত্বের এই অনিশ্চয়তা ও অদক্ষতা ছাত্র সংগঠনটিকে আরও পিছিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, মাঠপর্যায়ে ছাত্রদলের কর্মীসংখ্যা কমে গেছে, ক্যাম্পাসে সংগঠনের উপস্থিতিও দুর্বল। বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং হলভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা কার্যকর প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ফলে সংগঠনটি নির্বাচনের জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল।
তৃতীয়ত, প্রচারণার দিক থেকে ছাত্রদল ছিল একেবারে পিছিয়ে। অন্য সংগঠনগুলো যেখানে সোশ্যাল মিডিয়াসহ আধুনিক কৌশলে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে, সেখানে ছাত্রদল ছিল নিষ্ক্রিয়। শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করার মতো নতুনত্ব বা চমক কিছুই তারা উপস্থাপন করতে পারেনি। প্রচারণার ঘাটতি ভোটারদের কাছে দলটির বার্তা পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়।
চতুর্থত, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে। অনেকে এখন দলনিরপেক্ষ ও কার্যকর ছাত্ররাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। ছাত্রদল একটি দায়িত্বশীল, বিশ্বাসযোগ্য ছাত্রসংগঠনের ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি, লুটপাটসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগও ছাত্রদলের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মতে, ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে উপস্থিতি ছিল খুবই সীমিত। তাদের কর্মসূচি দুর্বল ও সংগঠন এখনো অগোছালো। এমনকি ছাত্রলীগ নিষ্ক্রিয় থাকা অবস্থাতেও তারা নিজেদের শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে পারেনি। বিপরীতে, শিবির অনেক আগে থেকেই প্রার্থী ঠিক করে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছে। তারা বছরের শুরু থেকেই ক্যাম্পেইন করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছে, এর ফলে তারা সাফল্যও অর্জন করতে পেরেছে।
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমানের মতে, জামায়াত যেভাবে তাদের ছাত্রসংগঠনকে সমর্থন দিয়েছে, বিএনপি তেমনভাবে ছাত্রদলের পেছনে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
সবাই মিলে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগোই-মির্জা ফখরুল
আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদ স্বাক্ষর কেবলই লোক দেখানো: নাহিদ
সকল ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে নির্বাচনের কাজ করতে হবে–আমির খসরু
জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছেন ২৫ দলের যেসব নেতা
জুলাই সনদের ৫ নম্বর দফা সংশোধনের প্রস্তাব সালাহউদ্দিন আহমদের
কৃষকের হাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়বে বিএনপি: তারেক রহমান
খাদ্যের নামে কী খাচ্ছি ?
এনসিপি উচ্চকক্ষে পিয়ারের পক্ষে, নিম্নকক্ষে নয়: সারজিস