ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এনা ট্রান্সপোর্টের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে ১০৭ কোটি ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ টাকা মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই মামলাটি করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ অবৈধভাবে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে।
সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়ার পর এ মামলা করা হয়।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
অগ্রণী ব্যাংকে শেখ হাসিনার ২ লকারে মিললো ৮৩২ ভরি স্বর্ণ
পরিবহন ব্যবসা থেকে ক্ষমতার বিস্তার
সিআইডি জানায়, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আশির দশকের পর পরিবহন খাতে ব্যবসা শুরু করেন। পার্টনারশিপে একটি পুরাতন বাস কিনে তার ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হলেও অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি প্রায় ২০টি বাসের মালিক হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে পরিবহন মালিকদের সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে তার প্রভাব আরও বাড়তে থাকে।
প্রথমদিকে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বও পান।
দীর্ঘ ১৬ বছর পরিবহন সেক্টরে একক আধিপত্য
সিআইডির তথ্যমতে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা ১৬ বছর তিনি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে পরিবহন খাতের গুরুত্বপূর্ণ সব পদ তার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
হরতাল ও অবরোধের সময় তিনি প্রকাশ্যে পরিবহন চালু রাখার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে নিজের কোম্পানির বাস রাস্তায় নামাতেন না। এটিও তার কৌশলের অংশ ছিল বলে সিআইডি জানায়।
সংগঠিত চাঁদাবাজির ভয়ংকর কাঠামো
সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী, খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার সহযোগীরা অত্যন্ত সংগঠিত ও ভয়ভিত্তিক পদ্ধতিতে চাঁদাবাজি করতেন। বিভিন্ন অজুহাতে বাস মালিকদের কাছ থেকে প্রকাশ্য ও মাসিক চাঁদা আদায় করা হতো। নতুন কোনো বাস রুটে নামাতে হলে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হতো।
এছাড়া নতুন বাস কেনার সময় মালিকদের সেই বাসের একটি অংশ এনায়েত উল্লাহকে দিতে বাধ্য করা হতো। টাকা না দিলে সেই বাস রাস্তায় নামতে পারত না। ফলে অনেক মালিক অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধে বাধ্য হতেন।
সারা দেশের পরিবহন খাতেই নিয়ন্ত্রণ
ঢাকার প্রতিটি বাস টার্মিনাল তার নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে জানায় সিআইডি। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন জেলার বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতিগুলো থেকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা হতো। সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী ব্যবহার করে পরিবহন সেক্টরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল।
সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ
বিএফআইইউ, বিভিন্ন ব্যাংক, ভূমি ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসহ একাধিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সিআইডি অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে ধানমন্ডির দুটি ফ্ল্যাট ও রূপগঞ্জের দুটি প্লট আদালতের আদেশে ক্রোক করা হয়। এসব সম্পদের আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
একই আদেশে তাদের নামে থাকা ৫৩টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়, যেখানে মোট স্থিতি ছিল প্রায় ১১০ কোটি টাকা। গত ৩ জুলাই এ আদেশ কার্যকর হয়।
১৯৯ ব্যাংক হিসাবে হাজার কোটি টাকার লেনদেন
সিআইডির বিশ্লেষণে দেখা যায়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ১৯৯টি ব্যাংক হিসাবে মোট জমা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা এবং উত্তোলন হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭ কোটি টাকা।
এর মধ্যে—
এনা ট্রান্সপোর্টের ৪৩টি হিসাবে জমা ৯৩৪ কোটি টাকা, উত্তোলন ৯০৬ কোটি টাকা
এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ৮টি হিসাবে জমা ৪১০ কোটি টাকা, উত্তোলন ৪০৮ কোটি টাকা
ব্যক্তিগত ৭৪টি হিসাবে জমা ৪৫৯ কোটি টাকা, উত্তোলন ৪০২ কোটি টাকা
সিআইডির অনুসন্ধানে ‘স্ট্রাকচারিং’ বা ‘স্মার্ট লেয়ারিং’ কৌশল ব্যবহার করে চাঁদাবাজির অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মোট ১০৭ কোটি ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ টাকা মানিলন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পাঁচ সহযোগীসহ মামলা
প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।