
সিডিএ কর্তৃক আওয়ামী লীগের পলাতক মন্ত্রী-এমপিদের প্লট এখনো বাতিল করেনি ।গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের তেরমাস পার হলেও সেই অবৈধ প্লটগুলো এখনো বাতিল করা হয়নি।শহরে বাড়ি-জায়গা থাকার পরও প্লট পেয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সিডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সিডিএর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এখনো আওয়ামী আমলের হর্তাকর্তারা বহাল থাকায় এমনটা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
গত ১৫ বছরে সিডিএতে চারজন চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের তিনজনকে নিয়োগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। টানা ১০ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালামের আমলে ১৫৫টি প্লটের মধ্যে ১২৮টি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তিনি সিডিকে লুটপাটের একটি প্রতিষ্টানে পরিনত করেন।
চট্টগ্রাম শহরে পারিবারিক জায়গাজমি থাকলে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম নেই।কিন্তু আওয়ামীলীগের সাবেক মন্ত্রী–সংসদ সদস্য, দলীয় নেতা, আওয়ামীপন্থী পেশাজীবী, সাংবাদিকসহ আরও ৫৮ জনকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ দেখিয়ে বিশেষ বিবেচনায় ২০১৩ সালে প্লট দিয়েছিল সিডিএ।সিডিএর প্লট বরাদ্দ প্রবিধানমালা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বা সিডিএর আবাসিক প্রকল্পে কোনো আবেদনকারী বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে আবাসিক প্লট থাকলে বা অতীতে সিডিএ থেকে প্লটের কোনো ইজারা দেওয়া হলে তাঁকে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম নেই। এ ক্ষেত্রে এটা মানা হয়নি কোন নিয়ম। দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে নতুন কোনো আবাসন প্রকল্প নেওয়া না হলেও আগের প্রকল্প থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে সংরক্ষিত স্থান ও জলাশয় ভরাট করে প্লট বানিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পলাতক মন্ত্রী, এমপি, দলীয় নেতা ও আওয়ামী পেশাজীবীদের।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে নিয়ম ভেঙে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া মোট ১৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলীয় নেতা, সিডিএর বোর্ড সদস্য, আওয়ামীপন্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ীসহ পেশাজীবীদের বিশেষ বিবেচনায় প্লট দেওয়া হয়। আবার নিয়ম লঙ্ঘন করে সংরক্ষিত প্লটের চেয়ে বেশি প্লট দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
চট্টগ্রাম নগরের অনন্যা আবাসিক ও কল্পলোক আবাসিক এলাকায় ২০০৯, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে তিন দফায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাবেক সাত মন্ত্রী ও আট সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের অন্তত ১৫ নেতা, ১১ সাংবাদিক, সিডিএর বোর্ড সদস্য ১০ এবং সিডিএর ৬২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্লট পেয়েছেন। ৪৩টি প্লট পান আওয়ামীপন্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীরা।প্লট বরাদ্দের আগে চারটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে বলে সিডিএর প্রবিধানমালায় উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। শুধু তা–ই নয়, বাজারদরের চেয়ে তিন থেকে ছয় গুণ কম দামে আবাসিক এলাকার মূল্যবান জায়গা পান প্রভাবশালীরা। আবাসিক এলাকায় কাঠাপ্রতি জায়গার দাম ছিল ২৫-৩০ লাখ টাকা। আর ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’দের প্লট দেওয়া হয় মাত্র ছয় লাখ টাকা করে।
জানাগেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ মুহাম্মদ আখতার উদ্দিন বিজ্ঞপ্তি ছাড়া ২৭টি প্লট বরাদ্দ দেন। এসব প্লট পান আওয়ামী লীগ নেতা, আওয়ামী ঘরানার শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীরা। নীতিমালা পরিপন্থী হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৪ সালে প্লটগুলো বাতিল করে সিডিএ। তবে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ১৪ জন প্লট ফিরে পেয়েছিলেন। বাকিদের মামলা বিচারাধীন।
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর সিডিএর ৪০৫তম বোর্ড সভায় অনন্যা আবাসিক এলাকায় ১২১টি প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ৫৯ জন ছিলেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা, বোর্ড সদস্য, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ লোকজন। বাকি ৬২ জন ছিলেন সিডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের ৩ থেকে ৫ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এরপর আবদুচ ছালাম চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় অনন্যা আবাসিকের সড়ক ও জলাধারের নকশা পরিবর্তন করে ২০১৩ সালে একসঙ্গে ১২১টি প্লট বরাদ্দ দেন বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। এসব প্লট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলীয় নেতা, আওয়ামী ঘরানার পেশাজীবী এবং সিডিএর বোর্ড সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।এরপর আবদুচ ছালাম ২০১৮ সালে অনন্যায় আরও চারটি এবং আরেক আবাসিক প্রকল্প কল্পলোকে তিনটি প্লট বরাদ্দ দেন বিজ্ঞপ্তি ছাড়া।
চট্টগ্রাম শহরে পৈতৃক ও নিজের নামে জায়গা–বাড়ি থাকার পরও আবেদন করেই প্লট পেয়েছিলেন হাছান মাহমুদ, মোশাররফ হোসেন, এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, আফছারুল আমীন, সামশুল হক চৌধুরী, এম এ লতিফ, নুরুল ইসলাম ও সাইফুজ্জামান চৌধুরী। একই সময়ে প্লট পান এ বি এম আবুল কাশেম, দিলীপ বড়ুয়া, মইনউদ্দীন খান বাদল, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চেমন আরা তৈয়ব, বীর বাহাদুর উশৈসিং ও দীপংকর তালুকদার।সরকার পতনের পর মোশাররফ হোসেন, এম এ লতিফ ও এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মারা গেছেন আফছারুল আমীন। অন্যরা আত্মগোপনে থাকায় পৈতৃক ও নিজের সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও প্লট নেওয়ার বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ছাড়াও বিশেষ বিবেচনায় প্লট পান তৎকালীন বোর্ড সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও এ এইচ এম বাহাউদ্দিন খালেক শাহজী, বোর্ড সদস্য রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মাহবুব-উল-আলম, সিডিএর তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন।
২০১৮ সালেও সিডিএর পাঁচ সদস্য বিশেষ বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ পান। তাঁরা হলেন সিডিএর ওই সময়ের বোর্ড সদস্য ও চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কে বি এম শাহজাহান, জসীম উদ্দীন শাহ, আ ম ম টিপু সুলতান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদের স্ত্রী জাহেদা বেগম, মো. জসিম উদ্দিন ও সোহেল মোহাম্মদ শাকুর। ২০১৮ সালের আগস্টে তাঁদের ৫ কাঠা করে প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়।
তিন দফায় সাংবাদিকদের ১১ জনকে ১০টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালে প্লট পান জিয়াউদ্দিন এম এনায়েতউল্লাহ ও মোয়াজ্জেমুল হকের ছেলে হাসান জিয়াদ। ২০১৩ সালে প্লট দেওয়া হয়েছিল আবু সুফিয়ান, একরামুল হক, আলী আব্বাস ও মহসীন কাজী (যৌথভাবে), এস এম ইফতেখারুল ইসলাম, সন্তোষ শর্মা ও অঞ্জন রায়কে। আর ২০১৮ সালে প্লট পেয়েছিলেন হামিদ উল্লাহ ও সেতু বড়ুয়া।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী জানান, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিবেচনায় প্লট নিয়ে মূলত নিয়ম ভেঙে সবাই মিলেমিশে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ লুটপাট করেছেন। এটি অনেক বড় অন্যায়। সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ প্লট বরাদ্দের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
প্লট বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সিডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, সিডিএতে আগে অনেক ধরনের অনিয়ম হয়েছে। বিনা বিজ্ঞপ্তিতে এবং বিধি ভেঙে দেড় শ প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে তাঁর কাছে অভিযোগ এসেছে। এগুলো নিয়ে কী ধরনের আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।







