পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও পুলিশ মধ্যে খুব বেশি ‘খাতির’ বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়

পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও পুলিশ মধ্যে খুব বেশি ‘খাতির’ বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ও অতিরিক্ত আইজিপি হাসিব আজিজ বলেছেন,সাংবাদিক ও পুলিশের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্ধুত্ব থাকতেই পারে। কিন্তু পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে এই দুই পক্ষের মধ্যে খুব বেশি ‘খাতির’ বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। বরং একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বা ‘অ্যাডভারসারিয়াল রিলেশনশিপ’ থাকাই রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিএমপি কমিশনার এসব কথা বলেন।

পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও পুলিশ মধ্যে খুব বেশি ‘খাতির’ বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে ও চ্যানেল ওয়ানের ব্যুরো প্রধান শাহনেওয়াজ রিটনের সঞ্চালনায় এই সভায় বক্তব্য রাখেন পিপলস ভিউ সম্পাদক ওসমান গণি মনসুর, দৈনিক কালের কণ্ঠের ব্যুরো প্রধান মুস্তফা নঈম, প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিয়া মো. আরিফ ও কার্যকরী সদস্য সালেহ নোমান প্রমুখ।

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন, প্রেস ক্লাবের অর্থ সম্পাদক আবুল হাসনাত, কার্যকরী সদস্য আরিচ আহমেদ শাহ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক রূপম চক্রবর্তী, ক্রীড়া সম্পাদক রুবেল খান, গ্রন্থাগার সম্পাদক মো. শহীদুল ইসলাম, সমাজসেবা ও আপ্যায়ন সম্পাদক হাসান মুকুল, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ফারুক আবদুল্লাহ সহ অন্যরা। এসময় চট্টগ্রামের কর্মরত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও পুলিশ মধ্যে খুব বেশি ‘খাতির’ বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়

তিনি বলেন,রাষ্ট্রকাঠামোর ভারসাম্য রক্ষায় পুলিশ ও সাংবাদিকের মধ্যে পেশাগত দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি । তাঁর মতে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও সংবাদমাধ্যম যখন এক রেখায় বা ‘অ্যালাইনমেন্টে’ চলে আসে, তখন রাষ্ট্রে বিপর্যয় নেমে আসে এবং ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। বিগত ১৭ বছরের শাসন ব্যবস্থাকে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি।
নিজের ও পুলিশ বাহিনীর কাজের গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশা করে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমার কাজে বা আমার সহকর্মীদের কাজে কোথাও ভুল, ত্রুটি, বিচ্যুতি বা গাফিলতি হলে আমি তার সমালোচনা চাই। আপনারা আমাকে ধরিয়ে দেবেন কোথায় কোথায় ভুল হচ্ছে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন। সেটা যদি আমার বিরুদ্ধে নিন্দাও হয়, আমি কিছু মনে করব না। আমরা সবসময় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।

পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও পুলিশ মধ্যে খুব বেশি ‘খাতির’ বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়

হাসিব আজিজ বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের সম্পর্কের বিষয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের যে বিভিন্ন অঙ্গগুলো আছে, সেগুলো যদি একটা অ্যালাইনমেন্টে থাকে বা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে এক হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থার যে কতখানি বিপর্যয় হয়, সেটা গত ১৭ বছরে জাতি দেখেছে।
পেশাগত সম্পর্কের জেরে যেন জবাবদিহিতা নষ্ট না হয়, সেদিকে ইঙ্গিত করে হাসিব আজিজ বলেন, আজকে আমি সাংবাদিক ভাইয়ের সঙ্গে এক জায়গায় দাওয়াত খেলাম, কাল তিনি আমাকে দাওয়াত দিলেন—এতে সম্পর্ক হলো। এরপর দেখা গেল আমার কোনো অপকর্ম বা ভুল তিনি বন্ধুত্বের খাতিরে রিপোর্ট করলেন না; এটি কোনো কাম্য পরিস্থিতি নয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য, জননিরাপত্তা ও জনসেবার জন্য প্রতিটি অঙ্গের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকা জরুরি। যার যার অধিক্ষেত্রের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিগত সরকারের প্রসঙ্গ টেনে সিএমপি কমিশনার বলেন, সাধারণ প্রশাসন, বিচারালয়, পুলিশ ও সাংবাদিক—সবাই একটা অ্যালাইনমেন্টে চলে এসেছিল। একটা অ্যালাইনমেন্টে তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। এর ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা একটা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। আওয়ামীপন্থী প্রশাসন, আওয়ামীপন্থী বিচারক, আওয়ামীপন্থী পুলিশ, আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক—সব এক কাতারে মিশে গিয়েছিল। এর শেষ পরিণতি হিসেবে দেশে একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল।

মতবিনিময় সভায় সিএমপি কমিশনার পুলিশ সদস্যদের আচরণের বিষয়েও কথা বলেন। তিনি জানান, পুলিশ সদস্যদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা মনোভাবের দিক থেকে কঠোর হন, কিন্তু আচরণে অত্যন্ত বিনয়ী থাকেন। ‘পুলিশিং উইথ আ স্মাইলিং ফেস’—এই নীতিতে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, পুলিশ অফিসার ইউনিফর্ম পরা একজন সাধারণ নাগরিক ছাড়া আর কিছু নন।

পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও পুলিশ মধ্যে খুব বেশি ‘খাতির’ বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়

চট্টগ্রাম নগরীতে পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো বাহিনী বা সন্ত্রাসী গ্রুপ থাকতে পারবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে সন্ত্রাসীদের নির্মূলে ‘চরম পন্থা’ অবলম্বন করতেও পুলিশ পিছপা হবে না।

আসন্ন নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হাসিব আজিজ বলেন, “চট্টগ্রাম মহানগরীতে পুলিশ বাহিনী ছাড়া অন্য কোনো বাহিনী থাকতে পারবে না। সাজ্জাদ বাহিনী, লাল্টু বাহিনী, পল্টু বাহিনী—এই সমস্ত বাহিনী নির্মূল করতে হবে। নির্মূল মানে নির্মূল। প্রয়োজনে চরম পন্থা অবলম্বন করতেও আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করব না।”

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি ‘ভীতি সঞ্চার’ করার পরিকল্পনা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিতাড়িত স্বৈরাচার এবং তাদের বিদেশি প্রভুরা বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছে। নির্বাচনটি তাদের জন্য একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। তারা যেন এই টেস্টে ফেইল করে, সেজন্য আমাদের যা করার করতে হবে।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘ন্যাশনাল অ্যাসেট’ বা জাতীয় সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেন হাসিব আজিজ। তিনি বলেন, “১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ড. ইউনূস একমাত্র ব্যক্তি যিনি দেশে ও বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত। তাঁকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।”

পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে সিএমপি কমিশনার জানান, লুণ্ঠিত অস্ত্রের ৮০ শতাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্র পাহাড়ি এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের হাতে চলে গেছে বলে তথ্য রয়েছে। তবে নির্বাচনের আগে এসব উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে।

মতবিনিময় সভায় সম্মানীত অতিথি হিসেবে একুশে পদকপ্রাপ্ত ও দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, জনগণের একটা ভীতি থাকে, এই যে পুলিশ ভীতি যেটা, সেটাকে আমাদের মন থেকে দূর করে আমরা যাতে তাদের কাছে গিয়ে সমাজকে কিছু দিতে পারি এবং ভীতিটা দূর করে সমাজে যে সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে সমস্ত অপকর্ম হচ্ছে, সেগুলির ইনফরমেশনটা দিতে পারেন। ইনফরমেশনটা দিলেই কিন্তু পুলিশ গিয়ে সেখানে দেখবে এবং সেখানে তার প্রতিকার করার যে ব্যবস্থা সেটা ওনারা করতে পারেন। কারণ সব জায়গায় গিয়ে, পুরো শহরে আসলে ওনাদের পক্ষে গিয়ে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় এইদিকে আমাদের আরেকটু মনোযোগী হওয়া উচিত।

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email