এখনো দর্শক সিনেমায় গান চায় এবং ভালো গান চায়- এটা বুঝতে খুব বেশি দেরি হয়নি ঢাকাই সিনেমা নির্মাতাদের। বিশেষ করে যেসব সিনেমা পারিবারিক ড্রামা, প্রেম-রোমান্স বা সামাজিক গল্পে নির্মিত হয়, সেসব সিনেমায় গান না থাকলে যে দর্শককে তার আসনেই ঝিমিয়ে পড়তে হয়Ñ এটা দেখা যায়, গানবিহীন তথাকথিত আর্ট সিনেমা বিকল্প ধারার সিনেমাগুলোতে।
এমনকি এক সময় ফ্যান্টাসি বা অ্যাকশনধর্মী সিনেমাতেও গান দর্শকের কাছে বড় বিনোদনের খোরাক ছিল। সে রকম ‘রংবাজ’, ‘বদনাম’, ‘বাহাদুর’ প্রভৃতি অ্যাকশনধর্মী সিনেমাতেও মানুষের মুখে মুখে ফোটা জনপ্রিয় প্লে-ব্যাক দেখা গেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই অ্যাকশন সিনেমাতেও গান যেমন বহুশ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে না, তেমনি গানও থাকছে নিতান্তই নিয়ম রক্ষার খাতিরেই।
সামনে ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘মনপুরা’খ্যাত গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘কাজল রেখা’ সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে দেখা যাবে। এই সিনেমাটিতে ৪০টি গান থাকছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক। গানগুলো যদি হৃদয়গ্রাহী হয় এবং দর্শক ভালোভাবে গ্রহণ করে, তাহলে হয়ত এই সিনেমাটি দিয়েই ঢাকাই সিনেমায় ফের নতুন করে প্লে-ব্যাকের একটা বিপ্লব ঘটে যাবে। অন্যান্য নির্মাতারাও এগিয়ে আসবেন তাদের সিনেমায় প্লে-ব্যাকের প্রতি মনোযোগ দিতে এবং সংখ্যায় বাড়াতে। তাহলে নিঃসন্দেহে আবার ঢাকাই সিনেমায় আবার ফিরে আসবে আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঢাকাই বাংলা সিনেমার সূচনা থেকেই যে দুটি বিষয় পর্দার প্রাণ ছিল, এর একটি গল্প অন্যটি সেই সিনেমার গল্পভিত্তিক গান। এমনিতেও যেখানেই সুর আছে, এর সবই তো গান। কিন্তু সিনেমার গানে সুর থাকলেই হবে না, গল্পও থাকতে হবে। সেই গানের গল্পটি আবার উড়ে এসে জুড়ে বসার মতোও নয়- বরং ওই সিনেমার পুরো গল্পটিরই প্রাণ থাকবে গানটিতে। তবেই না সেটি প্লে-ব্যাক।
ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের শুরু থেকে পঞ্চাশ বছরে অনেক জনপ্রিয় গান হয়েছে, যেগুলো আজও মনের পিপাসা মিটিয়ে আসছে শ্রোতাদের। অথচ সিনেমাটি কবেই হয়ত হারিয়ে গেছে, খুঁজেও পাওয়া যাবে কোনোদিন এর রিল কিন্তু গানটি ঠিকই রয়ে গেছে। মুছে যায়নি রেকর্ড থেকে সেই জনপ্রিয় সিনেমাটির সাক্ষী হয়ে থাকা ছোট্ট একটুখানি গল্পের ইতিহাস। ইতিহাস হয়ে থাকার জন্যই একসময়ের চলচ্চিত্র নির্মাতারা অনেক চিন্তাভাবনা করে সিনেমার গল্পের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো গান তৈরি করতেন। তাদের ভাবনায় ছিল অনেক শ্রমের সিনেমাটি যতই ব্যবসা করুক, একসময় হয়ত এর রিল চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে বা হারিয়ে যাবে, কিন্তু যে সিনেমাটি বানিয়েছেন, সেটার পুরো গল্পের সারসংক্ষেপ যেন থাকে তার প্লে-ব্যাকে। এ জন্যই অনেক যত্নের সঙ্গে আগের গান তৈরি হতো। সুরকার সুর দিতেন অনেক যত্নের সঙ্গে যন্ত্রীরা তার সঙ্গে তাল মিলাতেন অনেক দরদের সঙ্গে, শিল্পী কণ্ঠ মেলাতেন অনেক আবেগের সঙ্গে।
ঢাকাই চলচ্চিত্রে সেই যত্নের সঙ্গে গাওয়া গানের ধারা এখন শুধুই ইতিহাস। গত দশ-পনের বছরে গানের সেই ধারাটিই ধীরে ধীরে শুরু করে হঠাৎই বদলেই গেছে। সিনেমায় প্লে-ব্যাক থাকছে একেবারেই নামকাওয়াস্তে। তাও এগুলোকে প্লে-ব্যাক বলা যাবে কিনা, এ নিয়েও রীতিমতো বিতর্ক আছে শিল্পীমহলে। একসময়ের জনপ্রিয় গানের সিনিয়র শিল্পীদের তো এগুলোকে প্লে-ব্যাক বলতেই আপত্তি আছে। যায়যায়দিনের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠলে বর্ষীয়ান ও বরেণ্য প্লে-ব্যাক শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, ‘দেখুন এই উপমহাদেশে গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে দুটি প্ল্যাটফর্মÑ সিনেমা এবং গ্রামোফোন রেকর্ড। এই দুটি মাধ্যমেই গান সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও কালজয়ী হয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির কালে এখন তো আগের সেই ট্রেন্ড নেইÑ মানুষ ইন্টারনেটের যুগে বাস করছে। কাজেই সেই যুগের জনপ্রিয়তার সঙ্গে বর্তমানের জনপ্রিয়তাকে তুলনা করলে বা চিন্তা করলে হবে না। এখন হচ্ছে চমকের যুগ। আগের এবং বর্তমানের মানুষের কনসেপচ্যুয়ালিই আলাদা।’
ঢাকাই সিনেমা এই ‘আলাদা’ হতে হতে এখন এমন হয়েছে যে, কণ্ঠশিল্পী মনির খানের ভাষায়, ‘আমাদের সময় একটি সিনেমার মহরত অনুষ্ঠানও এমন ছিল যে, সেখানে গানের কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, আর্টিস্ট, কলাকুশলী, ডিরেক্টর, প্রোডিউসার সব মিলে ২০০ জনের উপস্থিতি থাকত। রীতিমতো একটা মেলার মতো ছিল সেটা। এখন এমনই অবস্থা যে, একটি গানের জন্য যে গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী থাকে- তাদেরও একসঙ্গে ডাকা হয় না। সব কাজই আলাদা, আলাদাভাবে সারা হয়। কোথায় কী গান হচ্ছে, কেউ জানছেও না, দেখছেও না। ফিল্ম তো গোপনীয় কিছু নয়। ফিল্ম মানে বড় পর্দার ব্যাপার।’
এখন জনপ্রিয় শিল্পীরাও বলছেন, নির্মাতারা এখন প্লে-ব্যাকের গুরুত্ব আগের মতো দিচ্ছেন না। ফলে সিনেমায় গানের সংখ্যাও কমে গেছে। আগে যে সিনেমাটি ছিল আড়াই-তিন ঘণ্টার, সেখানে গানই থাকত সব মিলিয়ে ১৫-২০ মিনিটের। কোনো সিনেমায় এরও বেশি। বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমার একটি ‘রূপবান’। সিনেমার গল্পে-গল্পেই গান। ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’ সিনেমাতেও তাই।
এখন কোনো সিনেমায় তো গানই থাকে না। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী রাকায়েত হোসেন ‘গোর’ চলচ্চিত্রের জন্য ১১টি বিভাগে পুরস্কৃত হলে এ প্রসঙ্গে তার সিনেমায় গান না থাকা নিয়ে এই প্রতিবেদক মন্তব্য করেন, সিনেমাটিতে গান থাকলে হয়ত তিনি আরও একটি বিভাগে পুরস্কৃত হতেন। কারণ, বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ২৮টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম প্রধানই প্লে-ব্যাক। তখন তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, সে রকম প্লে-ব্যাক থাকলে হয়ত আরও একটি পুরস্কার জুটতো। পুরস্কারের সংখ্যাও আরও বাড়ত।’ এটা স্বীকার করেই এরপর তিনি আভাস দেন, আগামীতে তার সিনেমায়ও গান রাখবেন।
তবে অনেক নির্মাতা আছেন, গাজী রাকায়েত হোসেনের মতো বলেন না, তারাও তাদের সিনেমায়ও গান রাখবেন। বরং বলেন, বাজেটে কুলায় না বলেই সিনেমায় গান রাখতে পারছেন না।
প্লে-ব্যাক না থাকা বা কমে যাওয়ার পেছনে এখন এটাই প্রধান সমস্যা। সিনেমায় যারা গান রাখেন বা যারা রাখতে পারেন না, তাদের সবাই এটা একবাক্যে স্বীকার করেন। কেউ তো বলেন, যদি সেই মানের গান দিতে হয় তো, দুটি গানের জন্য যে বাজেট ধরতে হয়, পুরো সিনেমারই অর্ধেক। এই বাজেট সমস্যার জন্যই সিনেমায় গানের সংখ্যা কমে গেছে। আবার নামকাওয়াস্তে যে দুই-একটি গান থাকে, সেটাও প্লে-ব্যাক ধারার নয়। পুরোটাই হয় আইটেম সং, নয় মিউজিক ভিডিও ধাঁচের গান। গানে ঠোঁট মেলানো নায়ক-নায়িকাও সিনেমার গল্পের বাস্ততায় নেই। না সুরের জায়গায়, না কথার জায়গায়, কোথাওই নেই। নায়ক-নায়িকার নিতম্ব দোলানো নাচ ও তার বিশেষ অঙ্গভঙ্গির সস্তা বিনোদন দেওয়াই সিনেমাটির কাজ। হয়ত সেই অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে কোনো স্বপ্নের বা কল্পনার জগত। সিনেমার গল্পের বিষয়-বস্তু থেকেই বিচ্ছিন্ন। সে জন্যই জনপ্রিয় প্লে-ব্যাক শিল্পী মনির খান বলেন, ‘আগে যেসব প্লে-ব্যাক হয়েছে, সেটা শোনার জন্য ছবি না দেখেও চোখ বুঝেই সে গান শুনতে ভালো লাগে। এখন চোখে না দেখলে গানটি ভালো লাগে না। এখন মিউজিক ভিডিওর মতোই ফিল্মের গানও চলে গেছে চোখে, ফিল্মের গান এখন আর অন্তরে নেই।