বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনার পটভূমিতে দিল্লিতে একটা প্রশ্ন ঘুরেফিরেই আসছে – বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি এখন কী হওয়া উচিত?
জামায়াত এমন একটি দল, যাদের ইসলামি চিন্তাধারার কারণে ভারত চিরকাল তাদের রাজনৈতিকভাবে অস্পৃশ্য মনে করে এসেছে – এমনকি জামায়াতের সঙ্গে সংস্রব আছে বলে বিএনপির সঙ্গেও ভারত বহুদিন সম্পর্ক পর্যন্ত রাখতে চায়নি।
কিন্তু বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতের যে শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে সেই লক্ষণ স্পষ্ট, বিভিন্ন পাবলিক ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংসদের নির্বাচনেও তারা দাপুটে জয় পেয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে দিল্লিতেও কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করছেন, জামায়াত এখন সম্পূর্ণ নতুন চেহারার একটি দল, ‘কার্যত তারা যেন জামায়াত ২.০’!
ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ও দীর্ঘদিনের বাংলাদেশ গবেষক শ্রীরাধা দত্ত সদ্যই ঢাকা ঘুরে এসেছেন, সেই সফরে তিনি দেখা করেছেন জামায়াত, বিএনপি, এনসিপি-সহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে।
শ্রীরাধা দত্ত যেমন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, জামায়াতের নবীন প্রজন্মের নেতারা জিনস বা টি-শার্ট পরেও টেলিভিশন টক শোতে আসছেন– নতুন নতুন ধ্যান ধারণার কথা বলছেন।
সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের সঙ্গে বৈঠকের সূত্র ধরে তিনি বলেন, ‘আমি ড. তাহেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ধরুন আপনারা সরকার গড়ার মতো সংখ্যা পেয়ে গেলেন, তাহলে কি দেশে শরিয়া আইন আনতে চাইবেন?’
উনি তখন বলেন- এটা আবার কোথায় শুনলেন? আমরা কবে কোথায় বলেছি জিতলে আমরা বাংলাদেশে শরিয়া আইন আনব!’
‘আমি ১৯৭১-র কথাও জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারণ বহুকাল ধরেই আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা কী ছিল।’
‘তিনি তখন বললেন, মতিউর রহমান নিজামি বা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো নেতারা কিন্তু প্রকাশ্যেই একাত্তরে জামায়াতের অবস্থানের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন! আমরা ওটা স্বীকার করেছি!’
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেও জামায়াতের নতুন নেতৃত্ব আগ্রহী বলে তিনি ধারণা করছেন।
তিনি বলেন, ‘জামায়াতের যুক্তি হলো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের আপত্তির জায়গাটা হলো শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পুরো অর্জনটা তার নিজের বলে হাইজ্যাক করে নিয়েছিলেন! তারা এটাও বলছেন- ভারত যে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী, তা স্বীকার করতেও জামায়াতের কোনো দ্বিধা নেই!’
‘চট্টগ্রাম অস্ত্র পাচার মামলাই বলি বা ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যেকার অন্য নানা ভারত-বিরোধী ঘটনা– ওনারা এটাও বললেন যে ওগুলোতে জামায়াতের কারো হাত ছিল, এরকম একটা প্রমাণ দেখান!’
সবশেষে জামায়াতকে নিয়ে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ওরা আসলে দারুণ ‘চার্ম অফেনসিভ’, কথায় আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে– কিন্তু আসলে ওরা বাস্তবে কী করছে সেটা অবশ্য অন্য গল্প! আর ভারতকেও সেটা বুঝেই পা ফেলতে হবে বলে তার পরামর্শ।
তবে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা কিন্তু কিছুতেই মানতে রাজি নন যে, বাংলাদেশের জামায়াত আসলে কখনো তাদের চরিত্র পাল্টাতে পারে!
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘তাদের হাতে আসলে রক্ত লেগে আছে – এটা আমাদের বুঝতে হবে!’
‘আর জামায়াত হলো আসলে মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ– এরা সেই একই মুসলিম ব্রাদারহুড, যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশরসহ পৃথিবীর নানা দেশেই আছে।’
‘যেমনটা বলে না, চিতাবাঘ আসলে কখনোই তাদের গায়ের ডোরা বদলায় না – এখানেও বক্তারা অনেকেই নিশ্চয়ই একমত হবেন – জামায়াতও আসলে কখনোই পালটাবে না!’
এই যুক্তির ভিত্তিতেই তার বিশ্বাস – জামায়াতের অতীতের যা ট্র্যাক রেকর্ড, তাতে ভারত কখনোই তাদের বিশ্বাস করতে পারে না।
শ্রিংলা বলেন, এখানে আমাদের আসলে একটা সীমারেখা টানতেই হবে ... তারা মুখে কী বলছে সেটা শোনা একটা জিনিস, আর বাস্তবে কী করছে সেটাও দেখা দরকার।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতকে যে একটা কঠিন সংকট আর প্রবল দ্বিধার মধ্যে ফেলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।