অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরাই নির্বাচন বানচাল করার মতো অবস্থা তৈরি করছে: ফখরুল

অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরাই নির্বাচন বানচাল করার মতো অবস্থা তৈরি করছে: ফখরুল

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি মূলত একটি গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করা ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে।

শুক্রবার বিকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত শোভাযাত্রা পূর্ব সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি আয়োজিত এই কর্মসূচিতে হাজারো নেতা–কর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যানার, ফেস্টুন আর স্লোগানে মুখর ছিল পুরো নয়াপল্টন এলাকা।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘দেশের জনগণ এখন পরিবর্তনের অপেক্ষায়। অথচ কিছু দল ও গোষ্ঠী নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের দাবি তুলে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে।’
তার ভাষায়, নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবি মানে হচ্ছে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা। সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী গণভোটের প্রশ্ন নির্বাচনের সঙ্গে একদিনেই হওয়া উচিত। আলাদা করে গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।

তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের মদদে কয়েকটি ছায়াদল ও স্বার্থান্বেষী মহল একত্র হয়ে নির্বাচন ঠেকানোর পরিকল্পনা করছে। তারা জানে, জনগণ আর এই সরকারের সঙ্গে নেই। তাই ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার কৌশল নিয়েছে।

মির্জা ফখরুল স্পষ্ট করে বলেন, বিএনপি নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের পক্ষে। দুটি ভোট একসঙ্গে হলে খরচও কমবে, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাও সহজ হবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের সময় বাঁচবে। কিন্তু আলাদা করে গণভোট আয়োজন মানে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করা।

তিনি বলেন, দেশে এখন ন্যূনতম গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে আন্দোলন করতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে গণভোটের নামে কোনো দল যদি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে চায়, তাহলে জনগণ তা মেনে নেবে না।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর যে সৈনিক জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, সেটিকেই বিএনপি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এ উপলক্ষে প্রতি বছর দলটি শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে থাকে।

এদিনের কর্মসূচিতে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা অংশ নেন। রাজধানীজুড়ে ছোট-বড় শোভাযাত্রা এসে মিশে যায় নয়াপল্টনের মূল সমাবেশে।

বক্তৃতার একপর্যায়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য নতুন করে ঐক্য ও গণতন্ত্রের শপথ নেওয়ার দিন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তাই জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন থেকে পিছু হটব না।

সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি ‘গণভোট আয়োজনের দাবি’ তুলেছে। তাদের যুক্তি, জনগণের মতামত যাচাই ছাড়া নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না।

তারা দাবি করছে, গণভোটে জনগণকে প্রশ্ন করা হোক বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন তারা চায় কি না।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই দাবির পেছনে রয়েছে একটি নতুন কৌশল। নির্বাচনের সময়সীমা ও প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা, যাতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং অনিশ্চয়তার সুযোগে সুবিধা নেওয়া যায়।

একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এ ধরনের প্রস্তাবের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা চলছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার যখনই কোণঠাসা হয়, তখনই তারা বিকল্প ইস্যু তৈরি করে। এখন সেই ইস্যু হচ্ছে তথাকথিত গণভোট। কিন্তু জনগণ জানে, এই গণভোট কোনো নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া নয়, এটি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সাজানো এক নাটক।

তিনি বলেন, বিএনপি গণভোটের বিরুদ্ধে নয়, তবে সেটি হতে হবে নির্বাচনের অংশ হিসেবে এবং জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে।
আমরা গণভোট চাই, কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নয়। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফেরানোর অংশ হিসেবেই গণভোট হতে হবে বলেও যোগ করেন তিনি।

বিএনপির পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। দলটির দাবি, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারে না।

এই অবস্থায় গণভোটের নামে নতুন বিতর্ক তৈরি করে সময় নষ্ট করা ‘গণতন্ত্রের প্রতি অবমাননা’ বলে মন্তব্য করেন দলটির শীর্ষ নেতারা।

মির্জা ফখরুল বলেন, যদি সরকার ও সমমনা দলগুলো সত্যিই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে তারা এখনই সংলাপে বসে নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করুক। জনগণকে আর অপেক্ষায় রাখবেন না।

সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীরা মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে বারবার স্লোগান দিয়ে সাড়া দেন গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনো,’ ভোটাধিকার চাই, গণভোট নয়, নির্বাচন চাই। এমন সব স্লোগানে মুখর ছিল পুরো নয়াপল্টন এলাকা।

শোভাযাত্রা শেষে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে ফকিরাপুল, বিজয়নগর হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত বিশাল মিছিল বের হয়। বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত পুলিশের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই কর্মসূচি সম্পন্ন হয়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিএনপির এই অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে তারা আর কোনো বিলম্ব চায় না। গণভোট ইস্যুতে জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও বিএনপি তার নিজস্ব কৌশলে অটল থাকতে চায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আনিসুল হক বলেন, বিএনপি এখন এমন এক অবস্থানে আছে যেখানে সময়ই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। নির্বাচন বিলম্বিত হলে দলীয় ঐক্য নড়বড়ে হয়ে পড়তে পারে। তাই তারা চায় নির্বাচন ঘিরে জনগণের মনোযোগ ধরে রাখতে।

তিনি যোগ করেন, অন্যদিকে, জামায়াত ও সমমনা দলগুলো গণভোটের দাবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আলোচনায় প্রভাব ফেলতে চায়। এই দ্বৈত কৌশলই সামনে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সম্ভাবনা তৈরি করছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা যুদ্ধ করছি জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য। আজ নয়াপল্টন থেকে আমি দেশবাসীকে আহ্বান জানাই ভয় নয়, ঐক্যবদ্ধ হোন। নির্বাচনই আমাদের মুক্তির পথ, ষড়যন্ত্র নয়।

এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিএনপি মূলত আগামী নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। গণভোটের নামে যে নতুন রাজনৈতিক ইস্যু সামনে এসেছে, সেটিকে তারা একেবারে সরাসরি ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

আগামী কয়েক সপ্তাহে এই বিতর্কই দেশের রাজনীতিতে উত্তপ্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email