জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসতে সরকারের বেঁধে দেওয়া ৭ দিনের আলটিমেটাম শেষ হচ্ছে রোববার। কিন্তু দলগুলো এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসতে না পারায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
জামায়াতের পক্ষ থেকে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি বিএনপি। দলটি জানিয়ে দিয়েছে তারা নতুন করে আর আলোচনায় বসতে চায় না। আগের অবস্থানে অটল থাকা বিএনপির দাবি, জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হতে হবে এবং সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। অন্যদিকে এনসিপি জুলাই সনদে কোনো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি নয়। আর জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবিতে অনড় থেকে আন্দোলনে মাঠে নেমেছে। ফলে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি পদক্ষেপের প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারির ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় আদেশ প্রণয়নে কাজ শুরু করেছে, যা আগামী সপ্তাহের মধ্যে শেষ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত ২৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুটি সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপরই গণভোট এবং নোট অব ডিসেন্ট ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে চলে যায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এমন অবস্থায় ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে দলগুলোকে আলোচনা করে সাত দিনের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয় এ সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এরই মধ্যে ৬ দিন পার হয়ে গেলেও দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় বসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আলোচনার জন্য জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ইতিবাচক সাড়া না মেলায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন পরিস্থিতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। সূত্র জানিয়েছে, বাস্তবায়ন আদেশে ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে তাতে কিছু পরিবর্তন আনা হতে পারে। কমিশন বলেছে, বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তা হলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে। তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। আরেকটি প্রস্তাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারির মাধ্যমে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা দ্বিতীয় বিকল্পেও রাখা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুপারিশের তীব্র সমালোচনা করেন আইনবিদসহ রাজনৈতিক নেতারা। এ কারণে সরকার যে আদেশ জারির প্রস্তুতি নিয়েছে সেখানে ২৭০ দিনের স্থলে যত দিন লাগে, তত দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করার কথা বলা থাকতে পারে। একই সঙ্গে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব ছাড়া বাকি প্রস্তাবগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিল পাস করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইন মন্ত্রণালয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ প্রণয়নে কাজ শুরু করেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, দীর্ঘ আলোচনার পর ঐকমত্যে পৌঁছে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা হয়েছে। দীর্ঘ আলোচনার পর যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে সেটিকে সম্মান করতে হবে। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হয়নি তা জনগণ ঠিক করবে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে নিজ নিজ অঙ্গীকার অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। ফলে নতুন করে আর আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকতে হবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হতে হবে।
তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের দাবিতে অনড় জামায়াতসহ সমমনা ৮টি ইসলামপন্থি দল রাজপথে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে গণভোট ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারিসহ পাঁচ দফা দাবিতে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছে জামায়াত। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনের আগে গণভোট দিতে হবে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করব, ঘি আমাদের লাগবেই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিন সময় দিয়ে সরকার চূড়ান্ত দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। দলগুলোর যে বিপরীতমুখী অবস্থান, সেখান থেকে সমঝোতায় পৌঁছা অসম্ভব। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। রাজনৈতিক সংকটকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করে রাজপথ দখলের কর্মসূচি দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতিকে অনিশ্চিত জায়গায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি এড়াতে তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় বসানোর চেষ্টা করলেও অগ্রগতির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ রাজনৈতিক বিষয়টি এখন আর রাজনীতির মধ্যে থাকছে না; এটা মাঠে শক্তি প্রদর্শনের বিষয় হয়ে যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ নিয়ে যদি সিদ্ধান্ত নিতে না পারে তা হলে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। অনেকেই বলছেন, জুলাই সনদ করতে কৃষক, নারী, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয়নি। তা হলে রাজনৈতিক দলগুলো কি এসব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। তিনি বলেন, জুলাই সনদে সবকিছুই এসেছে। নির্বাচনের পর নতুন করে আবার সংলাপ হতে পারে। শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা সবাই কাজ করছেন। নির্বাচন নিয়ে কোনো সংশয় নেই।