
এরকম বাস্তবতায় গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে বেশ কিছু সহিংসতার ঘটনা। কয়েকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ঘটানো হয় ককটেল বিস্ফোরণও। খুলে ফেলা হয় রেললাইনের ফিসপ্লেটও। গত দুই দিনে শুধু রাজধানীতেই ঘটে তিনটি খুনের ঘটনা। এর বিপরীতে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয় নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ। শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযানও। প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকেও উচ্চারণ করা হয় কঠোর হুঁশিয়ারি। কিন্তু তারপরও চলছে আওয়ামী লীগের অগ্নিসন্ত্রাস। সর্বশেষ মঙ্গলবার ময়মনসিংহে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় এক চালককে।
ইতিপূর্বেও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যার ইতিহাস আছে আওয়ামী লীগের। বিরোধী দলে থাকা অবস্থাতে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগ ছিল দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আবার সরকারে থাকা অবস্থাতেও বাসে গান পাউডার কিংবা প্যাট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপানোরও অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।
তাদের অতীত অগ্নিসন্ত্রাসের ইতিহাস বিবেচনায় এবারও বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম নিয়েছে। এবার কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির নেতাকর্মীরা দেশ-বিদেশে পলাতক থাকলেও তারা টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে ক্রিমিনালদের দিয়ে বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বাসে আগুন : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও গত দুই দিনে রাজধানীর কমপক্ষে ১০টি এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন দেওয়া হয় ৯টি যানবাহনে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় মাস্ক পরা তিন যুবক এসে পাম্পে দাঁড়িয়ে থাকা আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাসে প্যাট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা চালক মো. জুলহাস মিয়া আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফুলবাড়িয়া থানার ওসি মো. রোকনুজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী বাসটি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আসে। সোমবার রাত ২টা ৪৫ মিনিটে বাসটি তেল নেওয়ার জন্য প্যাট্রোল পাম্পের সামনে এলে সব যাত্রীরা নেমে যান। তবে রাত বেশি হওয়ায় একজন নারী ও তার ছেলে বাসের ভেতরেই থেকে যান। এ ছাড়া বাসের ভেতরে ছিলেন চালক অথবা হেলপার জুলহাস। এ সময় তিনজন দুর্বৃত্ত এসে বাসে আগুন দিয়ে তাৎক্ষণিক চলে যায়। এতে বাসটিতে আগুন জ্বলতে থাকা অবস্থায় ভেতরে থাকা ছেলেটি বের হতে পারলেও তার মা অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। এ সময় ভেতরে থাকা জুলহাস অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। ওসি বলেন, নারী ও তার ছেলে ফুলবাড়িয়ার বাসিন্দা। আহত নারীকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিহতের মরদেহ থানায় রয়েছে। তার পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে চেষ্টা চলছে।
এ ছাড়া মঙ্গলবার রাত ৭টার দিকে রাজধানীর সূত্রাপুরে মালঞ্চ বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে গত সোমবার রাজধানীর ১০টি স্থানে ১৪টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আগুন দেওয়া হয় ৬টি বাস ও একটি প্রাইভেটকারে। গত শুক্রবারও রাজধানীতে একটি চার্চ এবং খ্রিস্টানদের একটি স্কুলে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে ফেলা হয় ফেনীতে।
নাশকতার জন্য ছড়ানো হচ্ছে টাকা : গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটাতে বিপুল পরিমাণ টাকা ঢালছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা। ককটেল বিস্ফোরণের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বেছে নেওয়া হচ্ছে ছিন্নমূল মানুষ-যারা নেশা, ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের।
ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, সোমবার রাতে বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় ২ জনকে হাতেনাতে এবং অন্য স্থান থেকে ৩ জনকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, ককটেল নিক্ষেপের জন্য লালবাগের এক যুবলীগ নেতা তাদের পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়েছিল। হাতেনাতে আটক দুই যুবকের একজন নেশাগ্রস্ত এবং সে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। হাতেনাতে আটক অন্য যুবক আসে ঢাকার বাইরে থেকে। তার বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
ডিএমপির উপপুলিশ পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, সোমবার ধানমন্ডিতে বাসে অগ্নিসংযোগের সময় সেখান থেকে প্যাট্রোলসহ একজনকে আটক করা হয়। টাকার বিনিময়ে ওই ব্যক্তি বাসে অগ্নিসংযোগ করে বলে জানায় সে। ঢাকায় অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের পলাতক এক নেতা এই অর্থ তাকে দিয়েছিল। তবে তদন্তের স্বার্থে ওই নেতার নাম-পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
বাসে লাঠি-বাঁশি রাখার নির্দেশ : একের পর এক বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন বাস মালিক ও শ্রমিকরা। করণীয় নির্ধারণে তারা গতকাল জরুরি বৈঠক করেন।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দফতর সম্পাদক কাজী মো. জুবায়ের মাসুদ বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি পলাতক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা দেশে নাশকতা সৃষ্টির জন্য বাসে অগ্নিসংযোগ করছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু বাস আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন বাস মালিকরা। তিনি বলেন, করণীয় নির্ধারণে মঙ্গলবার রাজধানীর সবগুলো বাস টার্মিনালের নেতারা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে টার্মিনালগুলোর নিরাপত্তা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিটি বাসের স্টাফদের লাঠি-বাঁশি রাখতে বলা হয়েছে। যাতে যেকোনো ঘটনার সময় প্রাথমিক প্রতিরোধসহ আশপাশের মানুষদের সতর্ক করা যায়। এ ছাড়া টার্মিনালের বাইরে যেসব বাস থাকবে সেসব বাসে অবশ্যই যেন একজন স্টাফ সারা রাত ডিউটি করেন তা নিশ্চিতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে টার্মিনালের বাইরে কোনো নির্জন রাস্তায় বাস পার্কিং না করে মালিক বা চালকের বাসার সামনে পার্কিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বললেন : গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ঘোষিত আগামী ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থান নিয়েছে এবং এটা নিয়ে কোনো ধরনের আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। যানবাহনে আগুন দেওয়া প্রতিরোধে রাস্তার পাশে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ এবং অপরিচিত কাউকে দেখলে পুলিশে খবর দেওয়ারও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য : গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিএমপি কমিশনার মেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, কিছু দিন ধরেই কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল রাজধানীতে জড়ো হয়ে ঝটিকা মিছিলের আয়োজন করছে এবং ককটেল বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তবে তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। ডিএমপি কমিশনার নগরবাসীকে কোনো আগন্তুককে আশ্রয় দেওয়ার পূর্বে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া এবং হোটেল, গেস্ট হাউসে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে অতিথি ওঠানোর অনুরোধ করেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ও যেকোনো ধরনের বাণিজ্যিক যানবাহন যেন কোনো অবস্থাতে অরক্ষিত না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ করেন।
আওয়ামী লীগের অগ্নিসন্ত্রাসের ইতিহাস : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে হোটেল শেরাটনের (বর্তমানে ইন্টার কন্টিনেন্টাল) সামনে বাসে আগুন দিয়ে ১১ জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় নাম আসে তৎকালীন যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমের। যদিও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয় এবং ‘সন্ধিগ্ধ আসামিদের’ বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ভবিষ্যতে কোনো অবস্থায় যাতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত না হয় সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
সব বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা : এদিকে দেশে চলমান বিভিন্ন সহিংসতা ও নাশকতার প্রেক্ষাপটে দেশের সব বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। মঙ্গলবার বেবিচকের সদর দফতর থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি বিমানবন্দরগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, সকল বিমানবন্দরে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিমানবন্দর এলাকায় সব ধরনের টহল বৃদ্ধি এবং মনিটরিং ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সম্ভাব্য যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও রাখতে হবে। এ ছাড়া সকল বিমানবন্দরে সর্বোচ্চসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সার্বিক ফায়ার সার্ভেইল্যান্স কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়েছে, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়।
সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মাদ কাউছার মাহমুদ বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। জনস্বার্থে সবাইকে সচেতন থাকার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে বেবিচক সদর দফতর থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দেশের সব বিমানবন্দরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।