আসন্ন ১৩ নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ হতে যাচ্ছে।
রায়কে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ রাজধানী ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
গত তিনদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ, পেট্রোল বোমা হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা জনমনে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর নিরাপত্তা জোরদারে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। র্যাবও টহল ও তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, নাশকতা ঠেকাতে রাজধানীর প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ও ৯টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৭টি মামলা দায়ের ও অন্তত ৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অগ্নিসংযোগে প্রাণহানি
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গত সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ১২টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ি এলাকায় আলম পরিবহনের একটি বাসে আগুন লেগে ঘুমন্ত অবস্থায় এক হেলপারের মৃত্যু হয়েছে।
রাজধানীর রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি সায়েন্সল্যাব, মিরপুর, বাড্ডা ও বসুন্ধরা এলাকায় বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। যদিও এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ককটেল বিস্ফোরণ ও পুলিশের অভিযান
বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণে তিনজন আহত হয়েছেন। একইভাবে মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ও মোহাম্মদপুরে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ককটেল হামলার ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার রাতে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের গেটে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
ডিএমপি জানিয়েছে, গত তিনদিনে নাশকতার অভিযোগে ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। পুলিশ দাবি করেছে, অনেককে টাকার বিনিময়ে ঢাকায় এনে সহিংসতায় জড়ানো হচ্ছে।
পুলিশের বক্তব্য ও তদন্ত
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সাংবাদিকদের বলেন, “নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের সদস্যরা আত্মগোপনে থেকে চোরাগুপ্তা মিছিল ও নাশকতার চেষ্টা করছে। অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪টি ঝটিকা মিছিল হয়েছে এবং ৫৫২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
তিনি জানান, “এইসব কর্মকাণ্ডে মূলত বাইরের জেলা থেকে আসা লোকজন জড়িত। তাদের অনেকেই অল্পবয়সী তরুণ, যাদের হেলমেট ও মাস্ক পরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
বাড়তি নজরদারি ও সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং
রায় ঘোষণার দিন ঘিরে আদালত এলাকা ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, হোটেল, মেস ও গেস্টহাউজে আগন্তুকদের পরিচয় যাচাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর ভিডিও ও উসকানিমূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এসব কার্যক্রমে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “যারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে বা অস্থিতিশীলতা ছড়ানোর চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হবে। গত ২৪ ঘণ্টায় আমরা ৪৪ জনকে গ্রেফতার করেছি।”
তিনি আরও জানান, “কিছু ব্যক্তি রিকশাচালক ও পথচারীদের টাকা দিয়ে স্লোগান দিতে বাধ্য করছে এবং সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিদেশে অবস্থানরত উসকানিদাতাদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে।”
জননিরাপত্তায় প্রশাসনের আহ্বান
ডিএমপি জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, “অপরিচিত কাউকে আশ্রয় দেওয়ার আগে তার পরিচয় নিশ্চিত করুন, এবং কোনও যানবাহন অরক্ষিত রাখবেন না। নাগরিক সহযোগিতা ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।”
প্রশাসনের দাবি, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে। বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংস ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা নেই।