আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চারপাশে ইতোমধ্যেই নিরাপত্তার প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সব বাহিনীর সদস্যদের বিশেষভাবে মোতায়েন করা হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে, স্থাপন করা হয়েছে অতিরিক্ত সিসিটিভি নজরদারি।
ট্রাইব্যুনাল ভবনের চারদিকে ভোর থেকেই দেখা যাচ্ছে টহলরত সেনা যান, ব্যাঙ্কার ও ব্যারিকেড।
নিরাপত্তা বাহিনী জানাচ্ছে, রায়কে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা রোধেই এই ব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, তবে সতর্কতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ রায়ের দিন কোনও পক্ষ যাতে সহিংসতা বা নাশকতার চেষ্টা না করতে পারে, সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সারাদেশে কোনও অশান্তি বা অপ্রীতিকর ঘটনার সুযোগ দেওয়া হবে না।
তিনি আরও জানান, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে এবং জনগণকে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
গত বছরের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ যেখানে সহিংসতা বিস্তৃত হয়েছিল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সেই সময়ের একাধিক ঘটনার সঙ্গে শেখ হাসিনার নাম জড়ায়। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ তোলে, তখনকার সরকার কর্তৃক দমন-পীড়ন, নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা হয়।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার আইনজীবীরা অভিযোগগুলোকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করে আসছেন। তাদের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষ মহল পুরোনো ঘটনাকে নতুন করে সাজিয়ে মামলা বানিয়েছে।
এ মামলার রায় ঘোষণাকে ঘিরেই এখন আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে।
রায় প্রকাশের তারিখ ঘনিয়ে আসতেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তেজনায় টইটম্বুর।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো রায়কে ‘ন্যায়বিচারের পথে বড় পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছে। তারা বলছে, জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত নৃশংসতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জবাব অবশেষে আইনের মাধ্যমে মিলতে যাচ্ছে।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, রায়ের দিনে কোনও ধরনের জমায়েত বা মিছিল-সমাবেশ বরদাস্ত করা হবে না।
শুধু রাজধানী নয়, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের সব বড় শহরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মোড়, রেলস্টেশন, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
গ্রামাঞ্চলেও পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে। বিশেষত যেসব এলাকায় অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটেছে, সেসব জায়গায় অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কঠোর নজরদারি চলছে। গুজব, ভুয়া তথ্য ছড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রশাসন।
নভেম্বরের ১৭ তারিখ সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে মিডিয়া, আইনজীবী, পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভিড় বাড়বে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের ভেতরে ও বাইরে বিশেষ প্রবেশপথ তৈরি করা হয়েছে এবং অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরই কেবল প্রবেশের সুযোগ থাকবে।
সূত্র জানিয়েছে, রায় ঘোষণার সময় বিচারক প্যানেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সফররত বিদেশি বিশেষজ্ঞ দলও কাজ করছে। গোপন কক্ষে রায় সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনালের পুরো ভবনকে উচ্চঝুঁকির জোন ঘোষণা করা হয়েছে।
ঢাকা ও অন্যান্য শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত বছরের সংঘর্ষের স্মৃতি এখনও তাজা এমন পরিস্থিতিতে অনেকে অকারণে বাইরে বেরোনো কমিয়ে দিয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রভাব পড়তে পারে। রায়ের দিন দোকানপাট খোলা রাখা, পরিবহণ মালিকদের বাস ও ট্রাক চলাচলে কোন অসুবিধা হবে কিনা।
ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রায়ের দিন নাগরিকদের সতর্ক অবস্থায় থাকতে পরামর্শ দিয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার উচ্চকমিশনার দপ্তরও পরিস্থিতি শান্ত রাখতে সব পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো রায়কে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য নির্ণায়ক মোড়’ হিসেবে চিহ্নিত করছে।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহু উত্থান–পতন ঘটেছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার রায় তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে রায় যাই হোক না কেন, দেশের স্থিতিশীলতা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বারবার একই কথা বলছে, বাংলাদেশের জনগণ শান্তিপ্রিয়। কেউ পরিস্থিতি অস্থির করতে চাইলে কঠোর হাতে দমন করা হবে।
