গবেষকরা বলছেন, ফাটলরেখাটির একটি অংশ সরাসরি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে জমাটভূমি, নদীভাঙন অঞ্চল, ঘনবসতি এবং তুলনামূলক নরম মাটি থাকায় মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই নতুন শনাক্ত ফাটলরেখাটি ৬ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প ঘটানোর ক্ষমতা রাখে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, আগের চেনা ঝুঁকির পাশে এই নতুন ভৌগোলিক তথ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। কারণ, এই অঞ্চলে ঘনবসতি, শিল্পকারখানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ ও রেলপথ রয়েছে যা ক্ষতির মাত্রা বাড়ানোর আশঙ্কা তৈরি করছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে এমন এক অঞ্চলে অবস্থান করছে যেখানে ভারতীয় ও বার্মিজ প্লেটের গতিবিধির প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে সামান্য যেকোনো পরিবর্তনও বড় ধরনের ভূমিকম্পে রূপ নিতে পারে। গবেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, নতুন ফাটলরেখা আবিষ্কার মানে ঝুঁকি বাড়া নয়—বরং আগে লুকানো অংশ শনাক্ত হওয়ায় প্রস্তুতি, অবকাঠামো নির্মাণ ও নগর ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এসব বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যৎ বিপদের সম্ভাবনা রয়ে যায়।
একই দিনে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঢাকার জনসংখ্যা ও অবকাঠামোর চরম বিপর্যস্ত অবস্থা। নগর গবেষকরা বলছেন, একটি আধুনিক পরিকল্পিত শহরে যেসব জায়গা বিন্যাস থাকা উচিত ঢাকাতে তার অর্ধেকও নেই।
পরিকল্পনানুসারে, একটি শহরের ভূমির ৬০ শতাংশ থাকা উচিত সড়ক, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান, পার্ক, ফুটপাত ও সবুজায়নের জন্য। বাকী ৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় আবাসন, বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক স্থাপনার জন্য।
কিন্তু ৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকা শহরে এই অনুপাত একেবারেই ভিন্ন। সাম্প্রতিক নগর জরিপ অনুযায়ী সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান মিলে আছে মাত্র ২৪ শতাংশ, অর্থাৎ প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক সুবিধা এখানে অনুপস্থিত।
ফলে একটি কাঠামোগত সংকট নিয়মিতভাবে মানুষের জীবনযাত্রাকে অস্বস্তিকর করে তুলছে। যানজটে প্রতিদিন গড়ে কয়েক লাখ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করছে, জলাবদ্ধতা বর্ষায় নিত্যসঙ্গী, সবুজায়ন দ্রুত কমছে, আর বিশুদ্ধ বায়ুর পরিমাণ প্রতিদিন আরও খারাপ হচ্ছে।
নগরবিদদের অনেকেই সতর্ক করে বলেছেন—ঢাকা যেসব অবকাঠামোগত চাপে রয়েছে, সেখানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। কারণ— ঘনবসতিপূর্ণ ভবন, সরু সড়ক, ফায়ার সার্ভিসের পৌঁছাতে না পারা, খোলা জায়গার অভাব, এবং পানি নিষ্কাশনের দুরবস্থা সবকিছু মিলিয়ে উদ্ধার–ত্রাণ পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে।
ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ শহরে প্রয়োজনীয় খোলা মাঠ, পার্ক, জলাধার ও প্রশস্ত সড়ক নেই। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—ঢাকায় তীব্র কম্পনে ভবনধস হলে মানুষ কোথায় আশ্রয় নেবে, কোথায় দাঁড়িয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হবে—এর কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।
শুধু ভূমিকম্প নয়—নগর সংকট, জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা মিলিয়ে সম্ভাব্য ‘সামাজিক ভূমিকম্প’-এর আশঙ্কাও বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে— প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি যত বাড়ে, মানুষ ততই অনিশ্চয়তায় ভোগে, সেই অনিশ্চয়তা রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষেত্রও তৈরি করতে পারে।
পরিকল্পিত উন্নয়ন না হলে এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি জোরালো না হলে ঝুঁকির এই বৃত্ত আরও বড় হবে। গবেষকরা তাই নতুন ফাটলরেখা আবিষ্কারকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন—যা শুধু ভূতাত্ত্বিক নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন— ঢাকার জন্য নতুন করে নগর পুনর্বিন্যাস জরুরি, যেখানে উন্মুক্ত স্থান, জলাধার রক্ষা ও সড়ক সম্প্রসারণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং ধাপে ধাপে ভেঙে পুনর্নির্মাণ করতে হবে ভূমিকম্পপ্রতিরোধী নির্মাণসংহিতা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। জরুরি সাড়া পরিকল্পনা (ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্ল্যান) বাস্তবভিত্তিক করে মহড়া বাড়াতে হবে।
একদিকে দেশের মাটির নিচে নতুন ফাটলরেখা, অন্যদিকে অসহনীয় নগর চাপ—দুটি সংকট একসঙ্গে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে এখনই গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তবে বিপদ আগামীর নয়—আজকের।







