
দেশের আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং সংকট থেকে উত্তরণে শরিয়াহভিত্তিক ৫টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার অনুমোদন হতে পারে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করবে এবং পরবর্তীতে ধাপে ধাপে একীভূতকরণ শুরু হবে। এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, পাঁচটির মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। দুই গোষ্ঠীই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিল। অভিযোগ রয়েছে, এসব ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আমানতকারীদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, যার বড় অংশ এখন আর উদ্ধার সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ, দায় ও মানবসম্পদ একত্রিত করে নতুন ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর মূলধনের বড় অংশ অর্থায়ন করবে সরকার। ফলে এটি সরকারি নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হবে। পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ও বিশেষজ্ঞরা।
প্রাথমিকভাবে প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশাসক হবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বা পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা, যিনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বও পালন করবেন। প্রশাসক নিয়োগের পর বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করা হবে।
প্রশাসক দল ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা যৌথভাবে পাঁচ ব্যাংকের আমানত, ঋণ, তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবসম্পদ বিভাগ একীভূত করবেন। পরে নতুন প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক এসব সম্পদ ও দায়ভার অধিগ্রহণ করবে। একীভূতকরণ শুরু হলে ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোর পুরনো নাম ও সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে নতুন নাম ব্যবহৃত হবে।
উপরোল্লিখিত ৫টি ইসলামি ব্যাংকে বর্তমানে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন ‘ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড’ বা আমানত বীমা তহবিল থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা শেয়ার আকারে রূপান্তর করা হবে। বাকি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ার রূপে রূপান্তরিত করে মূলধন পূরণ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের মে মাসে পাঁচটি ব্যাংকের সম্মিলিত আমানত নেমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায়। অথচ একই সময়ে তাদের সম্মিলিত ঋণস্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, একীভূত প্রক্রিয়ার পর খেলাপি ঋণ উদ্ধারে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি) গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখনও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন না হওয়ায় সেই প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ফলে আপাতত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়ায় ঋণ উদ্ধার অব্যাহত রাখবে।
এদিকে একীভূতকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকার ৮ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদকে। এ কমিটি একীভূত প্রক্রিয়ার আইনগত দিক, প্রশাসনিক কাঠামো ও সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা বিশ্লেষণ করছে।