
প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজারো মানুষের প্রাণহানি, অসহনীয় যানজট ও জনভোগান্তি—এগুলো আর ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনী ইশতেহারে সড়ক নিরাপত্তা ও যানজট নিরসনের সুস্পষ্ট কৌশল অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
শনিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘যাত্রী অধিকার দিবস’-এর আলোচনা সভায় এই দাবি তোলেন সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তিনি বলেন, “প্রতিবছর সড়কে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অসহনীয় যানজটের কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। অথচ এই খাতকে গুরুত্ব দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল স্পষ্ট পরিকল্পনা নিচ্ছে না। আমরা চাই, আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল তাদের ইশতেহারে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ অন্তর্ভুক্ত করুক।”
সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ পরিসংখ্যান
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ১১ বছরে দেশের বিভিন্ন সড়কে মোট ৬২,৬১৯টি দুর্ঘটনায় ৮৬,৬৯০ জন নিহত এবং প্রায় এক লাখ ৫৩ হাজার ২৫৭ জন আহত হয়েছেন।
এই বিপুল প্রাণহানির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতিও মারাত্মক। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এর বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া জ্বালানি অপচয়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার সমান।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক প্রভাব
যানজটের আর্থিক ক্ষতির বাইরে এর স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক প্রভাব আরও গভীর।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকার কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা বাড়ছে। ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ এমনকি কিডনি ও প্রজনন তন্ত্রেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সভায় বক্তারা উল্লেখ করেন, যানজটের কারণে দাম্পত্য কলহ ও পারিবারিক অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে, সংসার ভাঙার ঝুঁকি প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্নায়বিক ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, টিনএজদের বিপথগামিতা ও অপরাধ প্রবণতার পেছনে যানজট ও বেকারত্ব একটি বড় কারণ।
নীতি নির্ধারণে দুর্বলতা ও সড়ক পরিবহন আইন
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইন যাত্রী ও নাগরিক সমাজের মতামতকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করতে পারেনি। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা এখনো কমেনি। গণপরিবহনের মান উন্নত না হওয়ায় রাইড-শেয়ারিং মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশা ইত্যাদি ছোট ছোট বাহন দেশের প্রধান পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে সড়কে চাপ আরও বাড়ছে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে ৫৬ শতাংশ মানুষ বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পরিবহন ব্যবহার করছে। এটি জ্বালানি ব্যয় বাড়াচ্ছে, সড়কে গাড়ির সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করছে এবং যানজটকে আরও তীব্র করছে। গত কয়েক সরকারের ভুলনীতি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে যানজট এখন নগর-বন্দর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বক্তারা অভিযোগ করেন, হাজারো ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে সড়ক খাতে যুগোপযোগী সংস্কারের প্রত্যাশা থাকলেও এখনো কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তারা মনে করেন, এই অবহেলা চলতে থাকলে সড়ক খাতে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি আরও বাড়বে।
উন্নত গণপরিবহনের দাবি
আলোচনা সভায় বক্তারা উন্নত মানের, সাশ্রয়ী এবং সময়নিষ্ঠ গণপরিবহন ব্যবস্থা চালুর ওপর জোর দেন।
তারা বলেন, যদি রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (BRT), মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে এবং স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট কার্যকর করা যায় তবে যানজট অনেকাংশে কমে আসবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান
সভায় বক্তারা নির্বাচনী ইশতেহারে সড়ক নিরাপত্তা ও যানজট নিরসনের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান— সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জাতীয় অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নে কঠোরতা এবং দুর্নীতি দমন, শহরাঞ্চলে যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা, সড়ক নির্মাণে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ, দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসা সহায়তার জন্য বিশেষ ফান্ড গঠন।
উপস্থিত বিশিষ্টজনদের মতামত
সভায় আরও বক্তব্য দেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. মেজর অব (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার, গণধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান, জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, সংগঠনের সাবেক চেয়ারম্যান ও গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকুজ্জামান এবং সংগঠনের অর্থ সম্পাদক মাহমুদুল রাসেল।
তারা সবাই একমত পোষণ করেন যে সড়ক নিরাপত্তা এখন একটি জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয় এবং এর সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এই দাবি মূলত একটি বড় জাতীয় প্রয়োজনকে সামনে এনেছে। সড়ক নিরাপত্তা ও যানজট নিরসন কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতা, জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক জীবনের মানোন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের ইশতেহারে বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং কার্যকর উদ্যোগ নেয়, তবে দেশের সড়ক খাতের এই দীর্ঘস্থায়ী সংকট অনেকটাই নিরসন সম্ভব হবে।