
ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্দি, জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্টের মতো ভাইরাল রোগ বাড়ছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তন, ধুলাবালি ও ভাইরাস সংক্রমণই এই সময়ে রোগ বৃদ্ধির মূল কারণ। তারা সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
রোগীর সংখ্যা বাড়ছে
ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গত দুই সপ্তাহে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। শিশু রোগীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা এবং কাশির অভিযোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসছেন।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. তানজিলা রহমান বলেন, ‘এখন মৌসুম পরিবর্তনের সময়। হঠাৎ গরম-ঠান্ডার তারতম্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে ভাইরাস সহজে সংক্রমিত হয়। বিশেষ করে যাদের আগে থেকে অ্যাজমা, অ্যালার্জি বা ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।’
কারণ কী
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋতু পরিবর্তনের সময়ে হঠাৎ করে দিনের তাপমাত্রা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সাধারণ সর্দি-কাশি ভাইরাস (রাইনোভাইরাস) এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সহজে সংক্রমিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল হক বলেন, ‘সাধারণ ভাইরাসজনিত সর্দি-কাশির চিকিৎসা প্রধানত উপসর্গভিত্তিক। কিন্তু অবহেলা করলে নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিসের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
শিশু ও বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সর্দি-জ্বর-কাশি মারাত্মক জটিলতায় রূপ নিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশন বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিতে হবে।
শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মেহজাবিন সুলতানা বলেন, ‘মা-বাবাদের উচিত শিশুকে অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম পরিবেশ থেকে রক্ষা করা। পর্যাপ্ত পানি পান করানো, হালকা গরম স্যুপ বা তরল খাবার দেওয়া এবং প্রয়োজনে প্যারাসিটামল দেওয়া যেতে পারে। তবে স্ব-উদ্যোগে অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়ানোই শ্রেয়।’
কী করবেন–ডাক্তারদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, এই সময়ে কিছু সাধারণ অভ্যাস মেনে চললে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন–শরীর হাইড্রেটেড রাখলে ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা সহজ হয়।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন–ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (লেবু, কমলা, আমলকী) এবং সবজি বেশি খান।
ঘরের ভেতরে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন – ধুলাবালি কমিয়ে ঘরের বাতাস পরিষ্কার রাখুন।
গরম পানির ভাপ নিন – নাক বন্ধ বা কাশি কমাতে সহায়ক।
মাস্ক ব্যবহার করুন – যদি কাশি বা হাঁচি থাকে, অন্যকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে মাস্ক ব্যবহার জরুরি।
পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নিন – শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী রাখতে ঘুম গুরুত্বপূর্ণ।
অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক এড়িয়ে চলুন – ভাইরাসজনিত সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় না।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন
ডাক্তাররা পরামর্শ দিচ্ছেন নিম্নলিখিত উপসর্গ দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতালে যেতে –টানা ৩ দিনের বেশি জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির উপসর্গ, বুকের ব্যথা, শিশুদের খাওয়া না খাওয়া বা অতিরিক্ত কান্না, ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ (মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কম হওয়া)।
জনসচেতনতার প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋতু পরিবর্তনের সময় শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতা নয়, সামাজিকভাবে সতর্কতা জরুরি। অফিস-স্কুলে অসুস্থ অবস্থায় উপস্থিত না হওয়া, ভিড়ের মধ্যে হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে চলা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মো. রাশেদুল হাসান বলেন, ‘আমরা যদি মাস্ক পরিধান, হাত ধোয়া এবং জনসমাগমে সতর্কতা মেনে চলি তবে অনেক ভাইরাস সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব।’
সরকারের উদ্যোগ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, তারা ইতোমধ্যেই ঋতু পরিবর্তনের সময়ে রোগ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করেছে। টেলিভিশন, রেডিও ও সামাজিক মাধ্যমে মানুষকে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
উপসংহার
ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে সর্দি-কাশি-জ্বর একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা হলেও অবহেলা করলে তা গুরুতর জটিলতা তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ হলো—সচেতন থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। সুস্থ জীবনযাপনই এই মৌসুমি অসুস্থতা থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায়।