৯ মাসে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে ৮৪ জন

৯ মাসে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে ৮৪ জন
জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে রাজনৈতিক সংঘাত। সংঘাতের অধিকাংশ ঘটনায় বিএনপির সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য-উপাত্তে। আর এসব সংঘাতে অধিকাংশ ঘটনাই ঘটছে আধিপত্য বিস্তার আর পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের ফেলে যাওয়া সম্পদ দখলকে কেন্দ্র করে। যদিও বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা’ নিশ্চিতের লক্ষ্যে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে পদচ্যুত বা বহিষ্কারের মতো কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও লাগাম টানা যাচ্ছে না সংঘাতের।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রাজনৈতিক সংঘাতে ৮৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৩২৩টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৭৯ জন। সংঘাতের প্রায় অর্ধেকই ঘটে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। বিএনপি-বিএনপি মধ্যকার ১৫৪টি সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জন। বিগত ৯ মাসে ৩২৩টি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনায় ২৬৩টি ঘটে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রাজনৈতিক সংঘাতের ৮১ শতাংশেরও বেশি ঘটনায় বিএনপি সম্পৃক্ত ছিল।

আসকের তথ্যে দেখা যায়, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার ৩০টি সংঘাতের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮ জন। বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর মধ্যকার ২০টি সংঘাতের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ৩টি। যুবদলের ১২টি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৯ মাসে প্রাণ হারান ৬ জন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ৫টি সংঘাতের ঘটনায় মারা যান ৪ জন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও এনসিপির মধ্যকার একটি সংঘাতের ঘটনায় প্রাণ হারান ৫ জন।

অন্যদিকে শুধু জুলাই মাসেই দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় নয়জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। এই ৯ জনের মধ্যে চারজন বিএনপির। মৃত্যু হয় গোপালগঞ্জের সংঘাতে। বিএনপির চারজনের মধ্যে তিনজনই দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আর একজন জামায়াতের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন।

রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত বেড়ে যাওয়ার কারণ স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক গ্রুপিং, সে সঙ্গে আছে দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার, কমিটি গঠন, জমি-সংক্রান্ত বিবাদ, স্কুল কমিটি গঠন, বাজার ও বালুমহাল দখলসহ বিভিন্ন কারণে এসব সংঘাতের ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের নেতাকর্মীদের দখলে যা ছিল তা এখন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা দখলে নিচ্ছেন। আর তা নিয়েই নিজেদের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা ঘটছে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ময়মনসিংহের পাগলা থানার কান্দিপাড়া বাজারে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে স্থানীয় বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদল জড়িয়ে পড়ে। এতে আটজন আহত হন।

স্থানীয়রা জানান, কান্দিপাড়া বাজারের ইজারার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ হয়। একই দিনে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ২০ জন আহত হন। এখানেও রাজনৈতিক আধিপত্য ও বাজারে মহড়া দেওয়া নিয়ে সংঘাত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে স্থানীয় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বাবুল আক্তার (৫৫) নামে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের কচুয়ায় ইউনিয়ন বিএনপির সম্মেলন ঘিরে সংঘর্ষে বিএনপি নেতা শওকত হোসেন (৫০) মারা যান। ১৩ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার মিরপুরে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত খোকন আলী (৩৫) নামে এক জামায়াত কর্মীর মৃত্যু হয়। বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে জামায়তের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের এ সংঘর্ষ হয়।

অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘাতের লাগাম টানতে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা’ নিশ্চিতের লক্ষ্যে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে সাত হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে পদচ্যুত বা বহিষ্কার করেছে বলে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

চলতি মাসে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি এ তথ্য জানান। ইতিমধ্যে সাত হাজারেরও বেশি দলীয় সদস্যের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ফেসবুক পোস্টে তারেক রহমান লিখেছেন, ‘দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অসদাচরণের দায়ে কেউ পদচ্যুত হয়েছেন; আবার অনেকেই বহিষ্কৃত হয়েছেন। বহুমুখী অপপ্রচারের মাঝেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না, তবে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো ছিল অপরিহার্য। শৃঙ্খলা কোনো দুর্বলতা নয়; বরং সেটিই আমাদের শক্তি।’

এ ছাড়া ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email