তারেক রহমান ব্যক্তি নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতীক

তারেক রহমান ব্যক্তি নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতীক

তারেক রহমান ব্যক্তি নয়, এক রাজনৈতিক অধ্যায়।ইতিহাসের ধারক এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতীক। তিনি শুধু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নন; তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সন্তান; একটি রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনকারী নাম, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তারেক রহমানের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন ঘিরে যে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিছক একজন নেতার দেশে ফেরা নয়। এটি ১৭ বছরের নির্বাসিত রাজনৈতিক জীবনের এক প্রতীকী সমাপ্তি এবং একই সঙ্গে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

২৫ ডিসেম্বরের প্রত্যাবর্তন যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তা হবে নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা। এই অধ্যায় কতটা গণতান্ত্রিক, কতটা সংঘাতপূর্ণ কিংবা কতটা সমঝোতামূলক হবে- তা নির্ভর করবে তার নেতৃত্ব, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এবং জনগণের প্রত্যাশার ওপর।বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সেই সন্ধিক্ষণে তারেক রহমান কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি সম্ভাবনা, একটি বিতর্ক এবং একটি প্রতীক্ষার নাম।
২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের দেশে ফেরার সম্ভাবনা বিএনপির জন্য নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দলীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, তাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীদের ঢল নামার সম্ভাবনা রয়েছে এবং একটি স্মরণীয় সংবর্ধনার প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে। এই প্রত্যাবর্তন শুধু বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে। কারণ সামনে রয়েছে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর জন্ম নেয়া তারেক রহমান বেড়ে উঠেছেন এমন এক পরিবারে, যেখানে রাজনীতি ছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের টালমাটাল সময়, সামরিক অভ্যুত্থান, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এবং পরবর্তীতে নির্মম হত্যাকাণ্ড সবই তার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিতে গভীর ছাপ ফেলেছে। তার পিতা জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক, একজন সেক্টর কমান্ডার এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি, যিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় সূচনা করেন। মাতা বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যদিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। এই রাজনৈতিক আবহেই তারেক রহমানের মানসিক ও রাজনৈতিক বেড়ে ওঠা। তবে তার রাজনৈতিক যাত্রা কেবল পারিবারিক পরিচয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল না। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সংগঠক হিসেবে সক্রিয় হন এবং ধীরে ধীরে বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেন।

নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর বিএনপি যখন একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়, তখন তারেক রহমান দলীয় কাঠামোর ভেতরে সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেন। তৃণমূল পর্যায়ে দলকে পুনর্গঠন, তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ- এমনটি বিএনপির অভ্যন্তরীণ মহলে স্বীকৃত। সমর্থকদের চোখে তিনি ছিলেন একজন আধুনিক সংগঠক, যিনি দলকে সময়োপযোগী করতে চেয়েছিলেন।
২০০৭ সালের ১/১১ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তারেক রহমানের জীবনে এক নাটকীয় বাঁক এনে দেয়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি গ্রেপ্তার হন, বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হন এবং পরবর্তীতে বিদেশে অবস্থান নিতে বাধ্য হন। এই সময় থেকেই শুরু হয় তার দীর্ঘ নির্বাসনের অধ্যায়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘ নির্বাসিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদাহরণ। এই নির্বাসন তার রাজনৈতিক পরিচয়কে যেমন বিতর্কিত করেছে, তেমনি তাকে একটি ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

লন্ডনে অবস্থান করেও তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেননি। বরং আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত, আন্দোলন ও কৌশল নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। অনেকে একে ব্যঙ্গ করে ‘রিমোট কন্ট্রোল রাজনীতি’ বললেও, সমর্থকদের মতে এটি ছিল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব ধরে রাখার কৌশল। এই সময় বিএনপি একাধিক রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে- নির্বাচন বর্জন, আন্দোলন ব্যর্থতা, দমন-পীড়ন এবং পুনর্গঠন। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে বিএনপির রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

তারেক রহমান বর্তমানে বাংলাদেশের ভোটার নন, দেশে ফেরার পর ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হবেন। এই বিষয়টি নিছক একটি ভোটার তালিকার প্রশ্ন নয়; এটি রাজনৈতিক প্রতীকী গুরুত্ব বহন করে। একজন রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।

তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রবাসী বাংলাদেশি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহল তার প্রত্যাবর্তন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তনের নজির রয়েছে বেনজির ভুট্টো, শেখ হাসিনা, নওয়াজ শরিফ- এই নেতারা প্রত্যেকেই নির্বাসন কাটিয়ে ফিরে এসে নিজ নিজ দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তারেক রহমান সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় নতুন করে আলোচনায় আসছেন।

লেখক- হাসান মুকুল,সংবাদ কর্মী

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email