
মানুষের পৃথিবীতে আসা যেমন নিশ্চিত, তেমনি একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াও অনিবার্য। তবুও কোনো প্রিয়জনের চলে যাওয়া কখনোই সহজ নয়—থেমে যায় সময়, থমকে যায় অনুভূতি।
৩০ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার (২০২৫) পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন আমাদের বড় খালাম্মা নুর নাহার বেগম (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ বছর। দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। রেখে গেছেন অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী, ছয় ছেলে ও তিন মেয়েসহ এক বিস্তৃত পরিবার।
সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি
নুর নাহার বেগমের জীবন ছিল এক সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। তখনকার সময়ের মতো তিনিও বেড়ে উঠেছিলেন সীমিত সুযোগ-সুবিধার সমাজে, যেখানে মেয়েদের শিক্ষা ছিল অনেকটা দূরের বিষয়। বাল্য বয়সেই বিয়ের পর শুরু হয় তাঁর কঠিন জীবনের অধ্যায়। সংসার, সন্তান ও পারিবারিক দায়িত্বের ভার নিয়েই কেটেছে তাঁর সমগ্র জীবন।
তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, সহনশীল ও পরহেজগার এক নারী। কৃষিকাজ হোক বা গৃহস্থালি, সব ক্ষেত্রেই তাঁর অদম্য উপস্থিতি ছিল অনন্য। দিনের পর দিন মাঠে-খেতে কাজ করে সংসার টেনে নিয়েছেন। কঠিন পরিশ্রমে গড়া সেই জীবন যেন আজও প্রেরণা হয়ে আছে তাঁর সন্তান-সন্ততিদের জন্য।
পরিবার ও ভালোবাসার বন্ধন
আমাদের নানীর চার কন্যা ও এক পুত্র ছিলেন। নানার মৃত্যুর পর সেই পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিলেন আমাদের নানী মা—যাঁর ভালোবাসায় আমরা সবাই এক ছায়াতলে বড় হয়েছি। নানীর মৃত্যুর পর নুর নাহার খালাম্মা সেই মমতার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি শুধু খালা ছিলেন না—ছিলেন নানীর মতোই মায়াময় এক আশ্রয়।
যখনই আমরা খালার বাড়িতে যেতাম, খালাম্মাকে সব সময় কর্মব্যস্ত দেখতে পেতাম। কখনো খেতে, কখনো মাঠে, কখনো বা পরিবারের জন্য দৌঁড়ঝাঁপে। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিন ছিল সংগ্রাম ও দায়িত্বে ভরা। অথচ মুখে কোনো অভিযোগ ছিল না—ছিল শুধু তৃপ্তির হাসি আর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা।
এক নদীর গল্প, এক জীবনের প্রতিচ্ছবি
খালাম্মার শ্বশুরবাড়ি ছিল নদীর পাড়ে। বর্ষায় নদীর ভয়ংকর রূপে তিনবার তাঁদের বাড়ি ভেঙে গেছে, তবুও তিনি হার মানেননি। নদীভাঙনের কষ্ট সহ্য করে নতুন করে ঘর বেঁধেছেন, সন্তানদের বড় করেছেন। নদী যেমন জীবন কেড়ে নেয়, তেমনি নদীর পাশেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন নতুন জীবনের স্বপ্ন।
ভালোবাসা, সম্পর্ক আর হারানোর বেদনা
নানীর মৃত্যুর পর পারিবারিক বন্ধন কিছুটা আলগা হয়ে গেলেও নুর নাহার খালাম্মা সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে রেখেছিলেন। নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন, ফোন দিতেন, খবর না পেলে কষ্ট পেতেন। আমার মা তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন; তাঁরা একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতেন।
আজ তাঁকে হারানোর শোক যেন আমাদের আরেকবার নিঃস্ব করে দিল। একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন আমাদের আশ্রয়দাতা প্রজন্ম—যাঁদের মায়ায়, দোয়ায়, সংগ্রামে আমরা গড়ে উঠেছি।
খালাম্মা আমাদের পরিবারে যে ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির উত্তরাধিকার রেখে গেছেন—তা আজীবন অমলিন থাকবে। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি,
“হে আল্লাহ, আমাদের খালাম্মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন,তাঁর জীবনভর ত্যাগ, শ্রম ও ইমানের প্রতিদান দিন।”
আর আমরা যারা রয়ে গেছি, আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুস্থতা, হায়াতে তৈয়্যেবা ও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসায় একত্রে থাকার তাওফিক দিন।
মা — জীবনের আলো, হৃদয়ের মণি
মায়ের তুলনা পৃথিবীতে কিছুই হতে পারে না। মা শুধু একজন মানুষ নন, তিনি পুরো একটা বিদ্যালয়, যিনি সন্তানকে শেখান ভালোবাসতে, লড়তে, দাঁড়াতে। মা মানুষ গড়ার কারিগর— তাঁর ত্যাগ, মমতা আর ধৈর্যের ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে একটি পরিবারের ভিত্তি।
আমার জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে মায়ের ছোঁয়া আছে। মা যেন আমার জীবনের রক্তস্রোত— আমার চলার পথের ব্লাড, আর চোখের আলো হয়ে জ্বলে থাকেন তিনি। মায়ের দোয়া, মায়ের ভালোবাসা— এই দুই-ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
জাহাঙ্গীর আলম
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
01749-336285
[email protected]







