৭ নভেম্বর: সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিপ্লব ও বাংলাদেশের নবজাগরণ”

৭ নভেম্বর: সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিপ্লব ও বাংলাদেশের নবজাগরণ”

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার পর, আমাদের দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড একটি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠে এবং মূল শিল্প-কল-কারখানা গুলোর উৎপাদনশীলতা স্বাধীনতার পূর্ববর্তী স্তরে ফিরে আসেনি। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মূল্যের সাহায্যের প্রবাহ সত্ত্বেও, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র ঘাটতি ছিল এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে দরিদ্রতম অসহায় মানুষের কাছে সাহায্য বিতরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ১৯৭৪ সালে, খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা সত্ত্বেও এক ভয়াবহ বন্যার পর, দুর্ভিক্ষ শুরু হয় যার ফলে প্রায় দশ লক্ষ লোক মারা যায়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পরিস্থিতি বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে সংবিধান সংশোধন করেন এবং স্বৈরশাসনকে “প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ “ করেন এবং বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করেন। বাকশাল তথা একদলীয় শাসনের কবলে পড়ে প্রিয় স্বদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন মাতৃভূমি অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বাকশালি স্বৈরাচারী শাসনের কবলে পড়ে।

সাংবিধানিক সংশোধনীর আট মাস পর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে এক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব তার পরিবারের সদস্যদের সাথে নিহত হন , যা দেশকে আরও গভীর অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেয়। আওয়ামী লীগ তার সহকর্মীদের একটি অংশ, খুনিদের সমর্থনে, তার দীর্ঘদিনের বন্ধু খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ ১৯৭৫ সালের আগস্টের ঘটনাবলির কারণে প্রায় ভেঙে পড়ে। শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত কিছু মধ্যম সারির মুক্তিযোদ্ধা অফিসার খন্দকার মোশতাক আহমাদের অভিভাবকত্বে যেভাবে সরকার চালাচ্ছিল তা সিনিয়র অফিসারদের অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। অনেকে, বিশেষ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর সশস্ত্র শাখা ‘গণবাহিনী’র সদস্যরা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের (অব.)-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে বিরাজমান উত্তপ্ত ও অস্থির অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে তৈরি হচ্ছিল। সাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটালে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব তাঁকে সেনাপ্রধানের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।” অন্যদিকে, খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুজন সহকর্মী কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার ৭ নভেম্বর সূর্য ওঠার আগে সেনাদের হাতে নিহত হন।

খালেদ মোশাররফের স্বল্পস্থায়ী ক্ষমতা দখলের ফলে ক্রমবর্ধমান বিভ্রান্তির মধ্যে রাষ্ট্রপতির পদে পরিবর্তন ঘটে। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতা ছাড়তে হয় এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭ নভেম্বর তিন বাহিনীর প্রধানগণ অর্থাৎ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জিয়া, নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএইচ খান এবং বিমানবাহিনীর এয়ার ভাইস-মার্শাল এমজি তাওয়াব উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। বিচারপতি সায়েম ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ তৃতীয় সামরিক আইন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দিলে জিয়া সেই পদে নিযুক্ত হন। বিচারপতি সায়েম ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলে জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪১ বছর ৩ মাস। আজ পর্যন্ত এই পদে তিনি সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি।

১৯৭৫ সালে মর্মান্তিক এক হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছিল। দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করে। তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান আর ঘাত-প্রতিঘাতে দেশে এক অনিশ্চয়তা নেমে আসে। সেই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে আবির্ভাব ঘটে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বিএনপির। স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, সেই সাথে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সে দলটি আজ ৪৭বছরে পদার্পন করল। এত বছরের মধ্যে দলটি রাষ্ট্রক্ষমতায় যেমন ছিল, তেমনি বিরোধী দলেও ছিল দলটি। বিএনপির আজকের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে কথা বলতে গেলে দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। এটা অনস্বীকার্য যে, দেশের এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে জন্ম হয়েছিল বিএনপির।

একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আত্মপ্রকাশ ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় দিনটি চির স্মরণীয়। ৩রা নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করে স্বাধীনতার ঘোষক বীর সেনানি জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে। দেশ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু ৭নভেম্বর সিপাহী জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে এদেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন করে নির্মিত হয়। সিপাহী-জনতার বিপ্লব শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে নিয়ে আসে। সিপাহী-জনতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে টেনে এনে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে অপবিত্র ও অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেয়। সিপাহী-জনতার বিপ্লব জিয়াউর রহমানকে জনমানুষের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে।

জাতির চরম ক্রান্তিকালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই ক্ষণজন্মা মহানায়কের শাসনকাল স্বার্থানেশী সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দীর্ঘায়িত হতে দেয়া হয়নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে কিছু উশৃংখল, উচ্চাভিলাষী, শহীদ জিয়া পাঁচ বৎসরের কিছু বেশি সময় রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নিরলস কর্মপ্রচেষ্টায় এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার কারণে দেশের প্রতিটি মানুষ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়। তিনি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি প্রবর্তন করেছিলেন। শহীদ জিয়ার রাজনীতি ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোজা হয়ে থাকার রাজনীতি, দারিদ্র ও ক্ষুধা নির্বারণের রাজনীতি, সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। তিনিই বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেজন্যই দেশের মানুষের অন্তরে এখনও তিনি খোদিত আছেন। শহীদ জিয়া তাঁর আপন কর্মের মধ্যদিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সেনা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন কর্মের মাধ্যমে। সেজন্যই ইতিহাস তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে বর্তমানে শহীদ জিয়াকে খাটো এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মকে শহীদ জিয়ার অবদান জানতে না দেয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালানো হয়েছিলো। শহীদ জিয়ার অমূল্য অবদানকে মুছে ফেলতে একটি শ্রেণী সদা তৎপর। কিন্তু ইতিহাস সময়ের আয়না। এই আয়নায় অতীত ধরা পড়ে সহজেই। তাই অসত্য কথা ও তথ্য দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য সত্যকে আড়াল করা গেলেও স্থায়ীত্ব লাভ করা যায় না। ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই কাউকে বড়, কাউকে ছোট করার কাজে লিপ্ত। কিন্তু সত্যকে বাদ দিয়ে কিংবা পাশ কাটিয়ে কাউকে বড় কিংবা ছোট করা যায় না। কর্মই মানুষকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব এনে দেয়। শহীদ জিয়া আপন কর্মেই মহিমান্বিত হয়েছেন। শত চেষ্টা করেও তাঁকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে না।

১৯৭৭সালের ২২ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। ২৩ এপ্রিল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত ১৯৭৭ সালের ঘোষণাপত্র (সংশোধনী) আদেশ (১৯৭৭ সালের ঘোষণাপত্র নং ১) এর মাধ্যমে কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেন। সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ সংযুক্ত করা হয়। ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার’ পরিবর্তে সংবিধানে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাটি সংযোজন করা হয়। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পরিবর্তন করে সংযোজন করা হয় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচিতি ‘বাঙালির’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ করা হয়। উল্লেখ্য যে, একটি বিভক্ত, স্থবির ও হতাশাগ্রস্ত জাতিকে অভিন্ন পরিচয়ে আবদ্ধ করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা ব্যক্ত করেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মমতের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরন ভিন্ন। তাই শুধু ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ধর্ম-বর্ণ-জেন্ডার-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতীয়তাবাদের এ ধারণা বাংলাদেশে তৎকালে বিরাজমান কৃত্রিম রাজনৈতিক বিভেদের অবসান ঘটিয়েছিল। এছাড়াও জিয়াউর রহমান রেডিও টেলিভিশনে আযান প্রচারের ব্যবস্থা, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শিক্ষা বোর্ড চালু, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পাঠক্রমে ‘ইসলামিয়াত’ বিষয় চালু, ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকল্পে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সমস্যা জর্জরিত এ দেশে দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন এবং জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন, দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণের মাধ্যমে তাঁর বিখ্যাত ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।” জিয়াউর রহমান নিজে তাঁর এ ১৯ দফা কর্মসূচিকে ‘উৎপাদনের রাজনীতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

রাষ্ট্রনীতিবিদগণ জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচিকে তাঁর দুরনূষ্টির অনন্য নজির এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা মুক্তির সনদ বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত, জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি একদিকে যেমন ছিল রাজনৈতিক, অন্যদিকে উন্নয়নমূলক। বাংলাদেশকে স্বনির্ভর এবং আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে দেখতে প্রত্যাশী প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। ফলে কেবল জিয়ার রাজনীতির অনুসারী নয়, অন্যান্য রাজনীতিবিদগণও এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৭৭ সালের ১৩ জুন তিনি তাঁর দলের কর্মীদের ১৯ দফা কর্মসূচি জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

জিয়ার অনুসৃত ১৯ দফা কর্মসূচি, তাঁর গৃহীত কর্মপন্থা এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর প্রতি জনগণের আস্থা আছে কী-না তা যাচাইয়ের জন্য ১৯৭৭ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়া সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণভোট আয়োজন করেন। সাম্যবাদী দলের মোহাম্মদ তোহা, গণ আজাদী লীগের মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়নের হাজী দানেশ প্রমুখ বেশ কয়েকজন জাতীয় রাজনীতিবিদ জিয়ার সাথে বৈঠকের পর তাঁর আহুত গণভোটের প্রতি সমর্থন জানান। ২২ মে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এক বিবৃতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে গণভোটে অংশগ্রহণের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় গণভোট আয়োজনের আইনগত বৈধতা সম্পর্কে বিরোধী রাজনৈতিক মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপতি হলে জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, কৃষক-শ্রমিক প্রর্টির এএসএম সোলায়মানসহ কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে “গণভোট আয়োজনে কোনো আইনী বাধ্যবাধকতা নেই” বলে মন্তব্য করেন।” বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গেলে কোর্ট গণভোটকে আইনসিদ্ধ বলে রায় দেয়। জিয়ার পরিকল্পনা এবং নির্বাচন কমিশনের তফসিল মোতাবেক ৩০ মে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এ গণভোটে প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৯৮.৮ ভাগ ভোটার রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমের প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করে।”

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে ‘বাকশাল’ নামক একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। এই সংশোধনী বলে দেশের ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়ার উদ্যোগে দেশে পুনরায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাষ্ট্রপতির জারিকৃত ‘রাজনৈতিক দল-বিধি’ এর আওতায় ২১টি রাজনৈতিক দলকে সরকারি নিবন্ধন প্রদান করা হয়। রাজনৈতিক দল-বিধি আদেশ ছিল জিয়ার সামরিক সরকারের বেসামরিকীকরণের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিবন্ধ লাভকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল অন্যতম। জিয়ার প্রবর্তিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক নিষিদ্ধ করা তাঁর নিজের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটে।

শুধু বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই পুনঃপ্রবর্তন নয়, জিয়াউর রহমান মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও সুনিশ্চিত করেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার নিয়ন্ত্রিত ৪টি দৈনিক পত্রিকা এবং কিছু সংখ্যক সাত্মবিক পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা ছাড়া সকল পাত্র-পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামলে সংবাদপত্রের উপর থেকে সরকারি বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করা হয়। সংবাদপত্র ও বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করায় তাঁর শাসনামলে দৈনিকসহ অন্যান্য পত্রিকার সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক শ’তে।

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিজের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা চিন্তা করেন। ১৯৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করা হয়। যদিও তিনি জাগদলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন না, তবে এটি তাঁর অনুপ্রেরণাতেই গঠিত হয়েছিল। তৎকালীন উপ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে জাগদলের ১৯ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ৯ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে যোগদানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এ জন্য তিনি দ্বিতীয় সামরিক ফরমানের দ্বাদশ সংশোধনী জারি করেন। ১৯৭৮ সালের ১৭ এপ্রিল জারিকৃত এ সংশোধনী আদেশে রাজনৈতিক দল-বিধি আদেশ বাতিল করে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্য রাজনীতির অনুমতি প্রদান করা হয়। জিয়ার সমর্থিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) এর নেতৃত্বে ৬টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ নামক একটি রাজনৈতি জোট গঠন করা হয়। ২মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে এ জোটের চেয়ারম্যান করা হয়।

এদিকে দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ নির্বাচনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এটি ছিল সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে এ নির্বাচনে জিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট মনোনীত প্রার্থী জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী নৌকা। এ নির্বাচনে মোট ৫৩.৫৪ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। প্রদত ভোটের ৭৩.৬৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জাতীয় জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বনী এম এ জি ওসমানী পান ২১. ৭০ ভাগ ভোট। সংখ্যার হিসেবে প্রধান প্রতিদ্বনী ভূজন প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল ১ কোটিরও বেশি। এ নির্বাচন এবং এর ফলাফল নিয়েও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জোটের পক্ষ থেকে অনিয়ম ও তারচুপির অভিযোগ করা হয়। তবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ইতিহাসে ১৯৭৮ ভালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অপরিসীম গুরুত্ব অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এ ঊর্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সার্বজনীন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭৬ গালের ১২ জুন বঙ্গভবনের দরবার হলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান শপথ নেন। এ শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে এবং স্থিতিশীল রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার দ্বার উন্মুক্ত হয়। ২৯ জুন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে ২৮ জন মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রীর সম্বন্বয়ে একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন।

১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরই জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের অস্তিত্ব ও প্রযোজনীয়তা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। উল্লেখ্য যে, এ ফ্রন্টটি ছিল মূলত বিভিন্ন আর্দশ ও মতের রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের একটি প্ল্যাটফর্ম। নানা পথ ও মতের এ ফ্রন্ট নিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মোটেই স্বস্তিতে ছিলেন না। এছাড়া জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে যে উন্নয়নের রাজনীতি শুরু করেছিলেন, তার সঠিক বাস্তবায়নের জন্যও একটি শক্তভিত্তির রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল। এরূপ একটি বাস্তবতায় তিনি সমমনা লোকদের নিয়ে একটি আলাদা দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এ লক্ষ্যে জাগদল ও এর সকল অঙ্গদলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ নামে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন।” জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্রে বলা হয়- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইস্পাত কঠিন গণঐক্য, জনগণ ভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতি অর্জন এবং সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদের বিভীষিকা থেকে মুক্তির লক্ষ্যকে নিশ্চিত করার উদ্দেশে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গঠিত হয়েছে। জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ৭৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। জিয়াউর রহমান তাঁর রজনৈতিক দল বিএনপির অঙ্গসংঠন হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদী যুবদল’ ও ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর জিয়াউর রহমান জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৭৮ সালে ১৭ নভেম্বর আবারে রাজনৈতিক দলবিধি সংশোধন করেন এবং এ মোতাবেক রাজনৈতিক দলগুলের জন্য বাধ্যতামূলক নিবন্ধন প্রথা বাতিল করা হয়। ফলে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা সহজতর হয় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের দ্বার আরে উন্মুক্ত হয়।

১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়া সামরিক আইনের দ্বিতীয় ফরমানের মাধ্যমে সংবিধানের আরেকটি সংশোধনী আনেন। এটি দ্বিতীয় ঘোষণা আদেশ ১৯৭৮ (১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় ঘোষণা আদেশ নং-৪) নামে পরিচিত। এটি ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় সংসদে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী’ নামে গৃহীত হয়। এ সংশোধনীতে মন্ত্রী পরিষদের গঠন কাঠামো নির্দেশ করা হয়। পরবর্তী পনের বছরের জন্য জাতীয় সংসদে ৩০টি মহিলা আসন সংরক্ষনের বিধান কর হয়। এতে সুপ্রিম কোর্টের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ক্ষমতা এর বিচারকদের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান করা হয়। সংবিধানের মুখবন্ধ, চারটি মূলনীতি ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের আয়োজন বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে জারিকৃত সামরিক আইনবিধি, আদেশ, যোষণা, অধ্যাদেশ বা অন্যান্য আইন ও সংবিধানের সংশোধনীগুলোকে বৈধ করা হয়।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেশকে বেসামরিকীকরণ ও সদতাত্বিকীকরণে উল্লেখ্যযোগ্য পদক্ষেপ ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয়তাবাদী দল বিএনধি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মালেক উকিল) ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মিজান/বহ মোট ৩০টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে ৫১ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করে। এ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তারানী বল (বিএনপি) ২০৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মালেক উকিল) ৩৯টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদের প্রাধান্য বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী দল হিসেবে বিএনপি ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সব কয়টিই লাভ করেছিল। তাছাড়া উপনির্বাচনের চারটি সংসদীয় আসনের ৩টিতেই বিএনপির প্রার্থী এবং অন্য একটিতে মুসলিম লীগ প্রার্থী মিসেস রাজিয়া ফয়েজ জয় লাভ করেছিলেন। জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক ঘোষণাবলে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তিনি নানা সঙ্কটের আবর্তে নিপতিত বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে দেশের ইতিহাসে একজন সফল ও মহান রাষ্ট্রনায়কের খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর শাসনকালে তিনি কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, গ্রামকে উন্নয়নের মূল কেন্দ্র হিসেবে ধরে এর সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে নানাবিদ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশল হিসেবে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দান এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করেন। বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধকরণে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন। বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান তিনটি খাত হিসেবে কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প বা গার্মেন্টস খাত এবং বৈদেশিক শ্রম বাজার কে বিবেচনা করা হয়। এ তিনটি খাতের বিকাশের রয়েছে শহীদ জিয়ার অনন্য অবদান। কৃষি খাতের উন্নতির জন্য সমবায়ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন, ব্যাপকভিত্তি খাল খনন কর্মসূক্তি গ্রহণসহ তাঁর কৃষি ও কৃষকবান্ধব কর্মসূচির কথা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। জিয়ার উদ্যোগেই বাংলাদেশে তৈরি পোষাক শিল্প খাতের যাত্রা শুরু হয়। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়।

জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের বিপর্যন্ত অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলায় জিয়ার নিরলস প্রচেষ্টা বিদেশীদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের বিখ্যাত সাংবাদিক সুজান গ্রিন ঢাকা হতে প্রেরিত এক ডেসপাসে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎলোক রূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙ্গার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।’ মালয়েশিয়ার দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস-এ প্রকাশিত এই ডেসপাসে বলা হয়েছে যে, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো প্রেসিডেন্ট কার্যত এগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

জিয়া সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘোষণা এবং এর নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ উদ্দেশ্যে ‘পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারীসমাজের অবস্থার উন্নয়ন এবং জনজীবনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে যুক্ত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ‘মহিলা বিষয়ক’ একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়

প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিশুরা জাতির ভবিষ্যত। এদেশের শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদের সাংস্কৃতিক-মানসিক ও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৯ সালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে একটি শিশু পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিশু-কিশোর প্রতিভা বিকাশের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনে চালু করা হয় ‘নতুন কুঁড়ি’ নামক এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ যুবসমাজকে দেশপ্রেম, জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচি ও দায়িত্ববোধে উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তাদের জন্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় যুবসংস্থা ও গ্রামে যুব কমপ্লেক্স গঠন করা হয়। দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি শিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা শহীদ জিয়ার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এজন্য ও গ্রামে যুব কমপ্লেক্স গঠন করা হয়। দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়। স্বনির্ভরতা অর্জনের পরিপুরক হিসেবে গণস্বাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের প্রায় ৪০ লাখ নিরক্ষর লোককে স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়।

একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। এ সত্য উপলব্ধি করে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নানামুখী কর্ম উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। দেশজ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, পুরাতত্ত্ব, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, গ্রন্থাগার উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক পরিবেশের উৎকর্ষ সাধন, বাংলা ভাষার উন্নয়ন, সমকালীন শিল্প ও সাহিত্য সংরক্ষণ এবং গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন এ মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধিভূক্ত।

একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে শান্তি ও অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস নেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা, দেশের স্বার্থ সুরক্ষা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি উদ্দেশ্য সামনে রেখে নতুন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়। কোনো বিশেষ পথ-মতের রাষ্ট্রশক্তি নয়, বরং সব পথ-মতের অর্থাৎ দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই ছিল জিয়া সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিশেষ দিক। তাঁর সময়ে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও বিদ্যমান সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। উল্লেখ্য যে, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আরোহণ পূর্বে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল বলা যায়। এহেন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জিয়া দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী সব ধরনের মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্য থেকে বন্ধু জুটিয়ে ও তাদের সঙ্গে কার্যকর সহমর্মিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রকে মজবুত ভিত্তিতে স্থাপন করেন। বাংলাদেশ পঞ্চাশটিরও অধিক মুসলিম দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি এমন পরাশক্তি নতুন পরিস্থিতিতে ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়।

চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের প্রতি ইউরোপও বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। জিয়ার শাসনামলেই আল কুদসের বীর্থ কমিটি, ইসলামিক সলিডারিটি কমিটি, ইরাক, মিটিসহ মুসলিম ও আরব বিশ্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করে। তখন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রমের সাথেও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের একটি অস্থায়ী আসনে সদস্য নির্বাচিত হয়। জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা উদ্ভাবন করেন। ‘দাক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা’-সার্ক তাঁর চিন্তা ও প্রয়াসের ফসল।

একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার চালু:
বাংলাদেশে একুশে ও স্বাধীনতা পদক নামে দু’টি সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রবর্তন শহীদ জিয়াউর রহমানের অনবদ্য অবদান। ‘একুশে পদক’ হলো বাংলাদেশের একটি জাতীয় এবং অন্যতম সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের মহান স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাঁদের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে শহীদ জিয়াউর রহমান একুশে পদক চালু করেন। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিক্ষা, গবেষণা, অর্থনীতি ও সারিদ্য বিমোচন, শিল্প-সংস্কৃতি, সঙ্গীত, নৃত্য, চারুকলা, নাট্যাভিনয়, ভাস্কর্য এবং ভাষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ পদক প্রদান করা হয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক বঙ্গভবনে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ মোট নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পদক প্রদানের মধ্য দিয়ে একুশে পদক চালু হয়।

স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান এ পুরস্কার প্রবর্তন করে। জাতীয় জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশের নাগরিককে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৭৭ সালে ১০ জন (৫ জন মরণোত্তর) বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে জাতীয় জীবনে তাঁদের অসাধারণ অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ সম্মাননায় ভূষিতকরণের মাধ্যমে শহীদ জিয়া এ পুরস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেন।

শহীদ জিয়ার প্রাপ্ত খেতাব, সম্মাননা ও পুরস্কার:
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য দেশ বিদেশে অনেক খেতাব, সম্মাননা স্মারক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি হিলাল-ই-জুরাত খেতাব লাভ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, একজন সফল সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে রণাঙ্গণে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব হিরো অব দ্যা রিপাবলিক প্রদান করেন। মিশর সরকারের পক্ষ থেকে জিয়াকে প্রদান করা হয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ঙৎফবৎ ড়ভ ঃযব ঘরষব। যুগোস্লাভিয়া সরকারের পক্ষ থেকে জিয়াকে প্রদান করা হয় সর্ব্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদক অর্ডার অব দ্যা যুগোস্লাভ স্টার। রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কৃতিত্বের জন্য জিয়াকে ‘দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক কর্তৃকও বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের বায় শহীদ জিয়ার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। খুনী ফ্যাসিস্ট হাসিনা জিয়াউর রহমানের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বশতঃ বিমানবন্দরসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে জিয়াউর রহমানের নাম মুছে ফেলেছে।

বহির্বিশ্বে আমেরিকার শিকাগোতে জিয়াউর রহমানের সম্মানে ‘জিয়াউর রহমান ওয়ে’ করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ওয়ে শিকাগো শহরের রজার্স পার্ক এধাকার ৬৮০০ নর্থ ক্লার্কের ওয়েস্ট প্রাই ফ্লন্ডারের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত থেকে ২৭৫০ নর্থ ক্লার্কের পশ্চিম কলম্বিয়ার উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত নিয়ে বিস্তৃত। শিকাগো সিটি কাউন্সিল ২০১৪ সালে রজার্স পার্ক এলাকার, নর্থ ক্লার্ক স্ট্রিট-এব একাংশকে বাংলাদেশের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর নাম অনুসারে সম্মানসূচক জিয়াউর রহমান ওয়ে নামকরণ করে। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর তুরস্ক সরকার তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে রাজধানী আঙ্কারা একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম ‘জিয়াউর রহমান ক্যাডেসি’ রাখে।

২০০৪ সালে বিবিসির বাংলা পরিসেবা মাধ্যম ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ শিরোনামে পরিচালিত জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির তালিকায় জিয়াউর রহমান ১৯তম বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান ও একজন বীরউত্তম খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ জিয়া ছিলেন বাংলার আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। স্বাধীনতা উত্তর দুর্ভিক্ষ পিড়িত জনগণ শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর যখন শুধু অনিশ্চয়তা আর হতাশা ছাড়া কিছুই চোখে দেখছিল না, ঠিক তখনই জিয়া জ্বালিয়েছিলেন আশার আলো, বাংলাদেশের জনগণ বুকে বেঁধেছিল অনেক বড় স্বপ্ন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিপ্লবের মাধ্যমে এদেশের জনগণের হ্নদয়ের মনিকোঠায় জায়গা করে নেন শহীদ জিয়া। বাংলাদেশের নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমান দৈশিক স্বাধীনতা অটুট রাখার গ্যারান্টি খুঁজে পেয়েছিলেন তার প্রণীত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে। কুশলতা ও দক্ষতার সমন্বয়ে জিয়াউর রহমান তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি তৈরি করেছিলেন ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’-এর নীতিতে। আঞ্চলিক শক্তির ক্ষমতাকে ব্যালান্স করতে সেই শক্তির সাথে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শক্তিশালী দেশগুলোকে একই সুতায় বাঁধতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই নীতিরই বর্ধিত প্রকাশ হচ্ছে ‘সার্ক’। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ জিয়াউর রহমান এই কালজয়ী নীতির প্রয়োগেই সেই সময় আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা একটি উচ্চমাত্রায় উন্নীত হয় এবং তিনি দুনিয়াজুড়ে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন।

বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে জিয়া ইতিহাসে নিজের অক্ষয় স্থান নিশ্চিত করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, সময়োপযোগী গতিশীল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অবস্থান ও গতিপথ নির্ধারণ এসব বহুমাত্রিক সাফল্যের কথা সুবিদিত এবং বহুল চর্চিত। শহীদ জিয়া ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। এ দেশের গরিব মেহনতি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ছিল তার অন্যতম জীবন সাধনা।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ও মহান রাষ্ট্রনায়ক। জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। জাতীয় ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে একজন পরিত্রাণকারী হিসেবে রাজনীতিতে জিয়ার আবির্ভাব। তিনি শতধা বিভক্ত জাতিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জিয়া দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক অনুভূতির নাম। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’- ছিল জিয়ার বিশ্বাস ও ধ্যান। তিনি আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শুধু রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন। ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না। ফ্যাসিস্ট শাসনামলে সাময়িকভাবে জিয়াকে হেয় করা, তার সোনালি অবদানকে অস্বীকার করার অপতৎপরতা আমরা দেখছি। কিন্তু এ অপপ্রয়াস সফল হয়নি। জিয়াকে ভুলিয়ে দেয়া, তার অবদানকে মুছে ফেলার সাধ্য এ দেশে কারো হবে না। জিয়া থাকবেন দেশপ্রেমিক বিবেকবান প্রতিটি মানুষের অন্তরে এক জীবন্ত প্রত্যয় হিসেবে। মহান স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম কে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

ধন্যবাদান্তে
মোঃ জহিরুল ইসলাম (জহির)
বি.এস.সি ইন ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং,
এল.এল.বি
সাবেক সহ দপ্তর সম্পাদক
চট্টগ্রাম মহানগর যুবদল।
মোবাইল: ০১৮১৯৬১৭৩৮০
E-mail: [email protected]

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email