চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪৪ ধারা জারি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪৪ ধারা জারি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে রাতে ও দিনে দুই দফা সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল হোসেনসহ অন্তত ২ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।তবে শনিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এ সংঘর্ষ চলে। রবিবার (৩১ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকায় জোবরা গ্রামে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ সংঘর্ষ চলে।
সংঘর্ষের পর গতকাল দুপুরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। আগামীকাল সোমবার দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত এ ধারা বলবৎ থাকবে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন ১৪৪ ধারার আদেশ জারি করেন।
উপজেলা প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, হাটহাজারী উপজেলাধীন ফতেপুর ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট বাজারের পূর্ব দিক থেকে রেলগেট পর্যন্ত উভয় দিকের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। এ ছাড়া ২ নম্বর গেট এলাকায় সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ, গণজমায়েত কিংবা অস্ত্র পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উল্লিখিত এলাকায় পাঁচজনের বেশি ব্যক্তি একসঙ্গে চলাচল করতে পারবেন না।
দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত টানা সংঘর্ষ চললেও এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। বিকেল সাড়ে ৩টায় হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন সই করা বিজ্ঞপ্তিতে ১৪৪ ধারা চালু হলে এর প্রায় ৩০ মিনিট পরে ঘটনাস্থলে আসেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা।
চবিতে শিক্ষার্থী-স্থানীয় ফের সংঘর্ষ, রণক্ষেত্র

এর আগে, শনিবার (৩০ আগস্ট) রাত সোয়া ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী ২ নম্বর গেট সংলগ্ন একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। ওই শিক্ষার্থী রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাসায় প্রবেশ করতে গেলে দারোয়ানের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে দারোয়ান তাকে মারধর করেন।এ ঘটনায় খবর পেয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী সেখানে গেলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে সংঘর্ষ বাঁধে। পরে স্থানীয়রা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে জড়ান।

রাত দেড়টার দিকে ২ নম্বর গেট এলাকায় সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, এ সময় বহু শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এ সংঘর্ষে অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ২০–২১ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে তারা বিপদমুক্ত রয়েছেন।
চবি মেডিক্যালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ টিপু সুলতান বলেন, অনেক শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছেন।রাতে আমরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। যাদের অবস্থা খুবই গুরুতর আমরা তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষ বাধে। এসময় দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ শিক্ষকরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উভয় পক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হন। তাঁদের মাথা থেকে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। তবে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল না।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের সময় বিভিন্ন দিক থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দারা। শিক্ষার্থীরাও জড়ো হয়ে হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। তবে স্থানীয়দের সংখ্যা বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বারবার পিছু হটে এবং অনেক শিক্ষার্থী ইটের আঘাতে আহত হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির একজন সদস্য ও ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত সাংবাদিক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজনও আহত হন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শনিবারের সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে যেসব শিক্ষার্থীরা ভাড়ায় থাকেন, তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে স্থানীয়রা। সেই খবর পেয়েই মূলত তারা একত্রিত হয়ে উত্তরা আবাসিক এলাকায় যান। এ সময় দেশীয় অস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। এছাড়া ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করা হয়।

এদিকে সংঘর্ষের জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে জানিয়ে চবি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলার ঘটনায় বহু শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকের পরীক্ষা ছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।অন্যদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়েছে। এতে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার ফলে তারা প্রতিরোধ করতেই শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) চলমান সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, ছাত্রলীগ আমাদের শিক্ষার্থীদের দা দিয়ে কোপাচ্ছে। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় ইটের আঘাতে আহত হন তিনি। রক্তাক্ত অবস্থায় শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি সাংবাদিকদের সামনে এ মন্তব্য করেন।

অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, আমি নিজ চোখে দেখেছি, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ছেলেরা শিক্ষার্থীদের তাড়া করছে, দা দিয়ে কোপাচ্ছে। তাদের হাতে রক্ত ঝরছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিস্থিতি সহ্য করার মতো না। এ সময় তিনি কাঁদতে থাকেন।
উপ-উপাচার্য কামাল উদ্দিন অভিযোগ করে জানান, সকাল থেকে শিক্ষার্থীদেরকে ছাত্রলীগের, যুবলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা গ্রামবাসীর সাথে মিলে হামলা করছে। কোনো পুলিশ নেই, সেনাবাহিনী, বিজিবি নেই। আমি নিজে আহত হয়েছি। আমি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ করেছি। এরপরও কোনো পুলিশ ও সেনাবাহিনী নেই। আমরা কোনো মুল্লুকে আছি। সবাইকে দা দিয়ে কোপাচ্ছে। হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না। আমাদের মেরে ফেলছে। আমি অনুরোধ জানাচ্ছি গ্রামবাসী শান্ত হোন।

শিক্ষার্থীদেরও অভিযোগ , সংঘর্ষের সময় শুধু স্থানীয় বাসিন্দারা নয়, ছাত্রলীগের একটি অংশও তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।এদের মধ্যে যুবলীগ নেতা পালাতক হানিফের অনুসারী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে অস্ত্রধারী অনা হয়। ইটপাটকেলের পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় অস্ত্রধারীরা। এতে অনেক শিক্ষার্থী রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরাই প্রথমে হামলা চালায় এবং ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে।

অভিযানে যৌথবাহিনী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শেষে অভিযানে নেমেছে যৌথবাহিনী।রোববার বিকেল ৪টার দিকে যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করে। এসময় ক্যাম্পাসের আশপাশে যৌথবাহিনীর অন্তত ১০টি গাড়ি প্রবেশ করতে দেখা গেছে।এর আগে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকায় সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রোভিসি-পক্টরসহ ২০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের অধিকাংশই দেশীয় অস্ত্রের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত ও রক্তাক্ত।

 

 

 

 

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email