নদভী দম্পতিসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নদভী দম্পতিসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) ট্রাস্ট পরিচালিত আইআইইউসি টাওয়ার থেকে প্রায় ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপসহকারী পরিচালক কমল চক্রবর্তী বাদী হয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) মামলাটি করেন।

মামলার বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ। তিনি জানান, মামলায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তদন্তকালে এই অপরাধের সঙ্গে অন্যান্য কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে আসামি করা হবে।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে— আওয়ামী লীগের মনোনীত সাবেক সংসদ সদস্য ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীকেক। তার সঙ্গে আরও আসামি হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ, ট্রাস্টের সাবেক সদস্য প্রফেসর ড. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সালেহ জহুর, ড. ইঞ্জিনিয়ার রশিদ আহমেদ চৌধুরী, রিজিয়া সুলতানা এবং মোহাম্মদ খালেদ মাহমুদ।

এ ছাড়া অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন প্রফেসর ড. মো. ফসিউল আলম, প্রফেসর মো. আবদুর রহিম, ড. মো. শামসুজ্জামান, মোহাম্মদ বদিউল আলম, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, মুহাম্মদ শফিউর রহমান, অধ্যাপক ড. মাহি উদ্দিন, অধ্যাপক আফজল আহমদ এবং ড. মোজাফফর হোছাইন নদভী।

দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ৬ মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ট্রাস্টের ১২ কোটি ৭৯ লাখ ৪১ হাজার ৫৫৬ টাকা আত্মসাৎ করেন। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ট্রাস্ট একটি অলাভজনক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যার আয় শিক্ষাবৃত্তি, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা, ইসলামী গবেষণা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার কথা। কিন্তু আসামিরা ট্রাস্ট আইন ও বিধি উপেক্ষা করে ওই অর্থ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৫ সালে আইআইইউসি ট্রাস্ট চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় একটি প্লট ক্রয় করে এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় সেখানে ১৫ তলা বাণিজ্যিক ভবন আইআইইউসি টাওয়ার নির্মাণ করে। ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ভবনটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। তবে ট্রাস্টের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে সম্মানী, বোনাস, টিএ/ডিএ ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

দুদক জানায়, ট্রাস্টের নামে প্রাপ্ত আয় সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়ের কথা থাকলেও আসামিরা তা নিয়মবহির্ভূতভাবে আত্মসাত করেছেন। পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়ার পরই মামলা দায়ের করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আইআইইউসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৫ তলাবিশিষ্ট ভবনটি থেকে মাসে গড়ে ৯০ লাখ টাকা আয় হয়। এই আয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রদের কল্যাণে ব্যয় করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু দখল হওয়ার পর টাওয়ারটি থেকে নদভী সম্মানী নিতেন ১০ লাখ নয় হাজার ৩৩৩ টাকা। এর বাইরে গাড়ির জ্বালানি বাবদ নিতেন ৫০ হাজার এবং মোবাইল বিল বাবদ নিতেন সাত হাজার টাকা। এ ছাড়া দুই ঈদে উৎসব ভাতা হিসেবে প্রতিবার নিতেন ছয় লাখ ২২ হাজার ২২৩ টাকা। ওই সময় ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী দ্বীন মোহাম্মদ টাওয়ার থেকে সম্মানী নিতেন ছয় লাখ ৩০ হাজার ৬৬৭ টাকা। তিনিও আনলিমিটেড জ্বালানি এবং মোবাইল বিলবাবদ তিন হাজার টাকা করে পেতেন। এ ছাড়া বছরে দুটি উৎসব ভাতা হিসেবে প্রতিবার পেতেন চার লাখ ১৭ হাজার ৭৭৭ টাকা। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা সুলতানা টাওয়ার থেকে সম্মানী হিসেবে পেতেন দুই লাখ ৭০ হাজার ৬৬৭ টাকা। তিনি মোবাইল বিল পেতেন তিন হাজার টাকা। আর দুটি উৎসব ভাতার প্রতিটিতে পেতেন দুই লাখ ২২ হাজার ২২৩ টাকা।

নদভীর লুটপাটে সহায়তাকারীরাও পেতেন ভাতা
আইআইইউসির বেতনের পাশাপাশি টাওয়ার থেকে সম্মানী হিসেবে তৎকালীন রেজিস্ট্রার আখতারুজ্জামান কায়সারকে ৭০ হাজার, ট্রেজারার মহিউদ্দিন মাহীকে ৮৫ হাজার, ডিরেক্টর (ইনচার্জ) মাহফুজুর রহমানকে ৪০ হাজার, ইফতেখার উদ্দিনকে ২৫ হাজার, ফয়সাল আহমেদকে ২৫ হাজার, ডিরেক্টর (ইনচার্জ) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইফতেখারুল আলমকে ২৫ হাজার, কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিয়াউর রহমানকে ২০ হাজার এবং ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সারোয়ার আলমকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হতো। ‘নদভীর লুটপাটে সহায়তাকারী’ বিবেচনায় তাদের অতিরিক্ত এ ভাতা দেওয়া হতো বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তা-শিক্ষকেরা।

নিয়ম অনুযায়ী আইআইইউসির টাওয়ার কমিটির কোনো সদস্য মেডিকেল ভাতা পান না। কিন্তু রিজিয়া রেজা দুবাইয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য টাকা পাঠাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন নদভী। গলব্লাডার (পিত্তথলি) অপারেশনের জন্য নদভীর স্ত্রীর জন্য টাওয়ার থেকে পাঠানো হয় ৩০ লাখ টাকা। এরপর ওই টাকা সমন্বয় করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন কর্মকর্তারা। এ কারণে নদভী ওই সময় টাওয়ার কমিটির মিটিংয়ের রেজুলেশন সংশোধন করেন।

টাওয়ার কমিটির ১৫তম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের ১৪ মার্চ। ওই দিনের দুটি রেজুলেশনের কপি এ প্রতিবেদকের হাতে আসে। এর মধ্যে একটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু রেজা নদভী ও তৎকালীন রেজিস্ট্রার সফিউর রহমানের সই রয়েছে। তবে, মেডিকেল ভাতার কথা উল্লেখ করে জালিয়াতি করা রেজুলেশনে সই রয়েছে তিনজনের। সেখানে গৃহীত সিদ্ধান্তের তালিকায় মেডিকেল ভাতা প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর নদভীর স্ত্রী রিজিয়ার জন্য পাঠানো ৩০ লাখ টাকা সমন্বয় করা হয়।

টাওয়ারের আয়-ব্যয় যোগ হতো না মূল অ্যাকাউন্টে
জুলাই ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাববিবরণীতে আইআইইউসি টাওয়ার থেকে কোনো আয় দেখানো হয়নি। টাওয়ার ফান্ড থেকে চ্যান্সেলরের পূর্বানুমতি ছাড়া ডেবিট ভাউচারের মাধ্যমে দুই দফায় চার লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪৪ (৬) ধারার লঙ্ঘন। টাওয়ারের ইসলামী ব্যাংকের স্টেটমেন্টে এটির প্রমাণ মেলে। আবার টাওয়ার থেকে প্রাপ্ত মাসিক অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা না দিয়ে আলাদাভাবে জমা রাখা হতো। এরপর এসব টাকা নয়ছয় করা হতো। তিন বছরে এভাবে অন্তত ৩২ কোটি টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আয় একটি মাত্র অ্যাকাউন্টে জমা হবে এবং একটি মাত্র অ্যাকাউন্ট থেকেই অর্থব্যয় হবে। এ ছাড়া এ টাওয়ারের দাতা সংস্থা ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকেও বলা হয়েছিল যে, এ টাওয়ার হতে অর্জিত অর্থ শুধু আইআইইউসি’র উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email