
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেছেন, জাতীয় পর্যাযে আমাদের যত অর্জন রয়েছে, সব অর্জন অর্জিত হয়েছে ঐক্যের মাধ্যমে। ঐক্যবদ্ধ থাকার মাধ্যমে সফলভাবে আমাদের ভাষা আন্দোলন হয়েছে। যার মাধ্যমে আমাদের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে ১৯৭১ সালে বাংলার দামাল ছেলেরা স্বার্ধীনতা সংগ্রামে নেমেছিল। সেই যুদ্ধেও আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। সর্বশেষ ২৪ এর জুলাইয়ে অকুতোভয় ছাত্র-জনতা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে
স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। জুলাই বিপ্লবের ঐক্যবদ্ধ সেই আন্দোলনে কর্তৃত্ববাদী সরকারের অবসান ঘটেছিল। কাজেই ঐক্যই হচ্ছে আমাদের শক্তি। ঐক্যই হচ্ছে আমাদের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রুপদানের একমাত্র অস্ত্র। এজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আজ মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর ২০২৫) বেলা ১১টায় চবি জারুলতলায় মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমন আহ্বান জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে মহাসমারোহে ও আনন্দঘন পরিবেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস ২০২৫ উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষ্যে ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ সন্ধ্যা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, স্মরণ চত্বর ও বিভিন্ন হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সকল গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২.০১ মিনিটে বিজয় দিবসের সূচনালগ্নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিএনসিসির উদ্যোগে স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্যে বিউগলের সুরে শহীদদের স্মরণ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্যে চবি উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয়, অনুষদসমূহের ডিন, রেজিস্ট্রার ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
পুস্পার্ঘ অর্পণ শেষে সকাল ১০.৩০টায় উপাচার্য এবং উপাচার্যদ্বয়ের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় বিজয় র্যালি। র্যালিটি স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য চত্বর থেকে শুরু হয়ে অগ্রণী ব্যাংক, প্রশাসনিক ভবন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ (পুরাতন) সড়ক প্রদক্ষিণ করে চবি জারুলতলায় অনুষ্ঠানস্থলে এসে শেষ হয়। চবি জারুলতলায় বেলা ১১টায় “সম্প্রতিক বাংলাদেশে বিজয় দিবসের তাৎপর্য” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্থানীয় বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে অর্জন রয়েছে সেটিও আমরা ঐক্যের মাধ্যমে অর্জন করেছি। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ও সরকার সংস্কারের মাধ্যমে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। তিনি বলেন, ঐক্যের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যহত রয়েছে। ঐক্য বজায় থাকলে এ প্রচেষ্টা সামনে এগিয়ে যাবে। আমাদের এখানে দীর্ঘদিনের একটা জট ছিল সমাবর্তন হয় না। সবার সহযোগিতায় আমরা একটি মেগা সমাবর্তন করেছি। সবার সহযোগিতায় আমরা একটি অবিতর্কিত চাকসু নির্বাচন করেছি। সবার সহযোগিতা ছিল বিধায় হলে হলে দখলদারিত্ব মুক্ত করে মেধার ভিত্তিতে আসন বন্টন করেছি। এছাড়া ক্যাম্পাসে সহাবস্থান সুনিশ্চিত করতে পেরেছি। সবাই ঐক্য ও শান্তি বজায় রেখেছিল বিধায় ক্যাম্পাসে শান্তি বিরাজ করছে। উপাচার্য বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সচেষ্ট রয়েছি এবং আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। এ ঐক্য বজায় থাকুক। সবার সহযোগিতায় বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করতে চাই। বিজয় দিবসের প্রত্যাশা থাকবে, ঐক্যের মাধ্যমে সামনের কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে এবং আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন করা সহজ কিন্তু স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা বা টেকসই করা তারচেয়ে বেশি কঠিন। পরবর্তীতে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে সম্মিলিতভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার উদাত্ত আহ্বান রইলো।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এ দিনে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। এ বিজয়কে ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তিতে উন্নত করে আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে অনন্য নিয়ে যেতে হবে। দেশ থেকে সকল প্রকার লাঞ্ছনা-বঞ্চনা দূরীভূত করে আমরা যাতে একটি সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ গড়তে পারি, সেই প্রত্যাশা রইলো। তিনি সকল প্রকার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের সভাপতি চবি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। এরপর দীর্ঘ সময় কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র আপামর জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বশেষ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের থেকে আমরা মুক্তি লাভ করি। আশা ছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু আমাদের সেটি হয়নি। সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করা হয়। যার কারণে এ দেশের আপামর জনসাধারণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। দীর্ঘ নয় মাস সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করে এ দেশের স্বাধীনচেতা মুক্তিকামী মানুষ বুকের তাজা রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পাই। তাই ১৯৭১ হচ্ছে আমাদের বাস্তবতা এবং গর্বের জায়গা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, কিন্তু নানাভাবে শাসন পরিচালিত হওয়ায় প্রত্যাশিত সেই বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে উঠেনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থান হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ২৪ এর জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটকে ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ থেকে এ দেশের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান চবি উপ-উপাচার্য (প্রশসান) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন।
চবি প্রক্টর প্রফেসর ড. হোসেন শহীদ সরওয়ার্দীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান স্বাগত বক্তব্য রাখেন চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, চবি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী, চবি সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হাসমত আলী, চবি সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মান্নান, চবি লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি ও চবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মমতাজ উদ্দিন আহমদ, চাকসুর ভিপি ইব্রাহীম হোসেন রনি, জিএস সাঈদ বিন হাবিব ও চবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ মাহফুজ শুভ্র।
অনুষ্ঠানে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন চবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব হাফেজ আবু দাউদ মুহাম্মদ মামুন। অনুষ্ঠানে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ হতে পাঠ করা হয়। পবিত্র কোরআন থেকে পাঠ করেন চবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব হাফেজ আবু দাউদ মুহাম্মদ মামুন, পবিত্র গীতা থেকে পাঠ করেন চবি সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাজপতি দাশ, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ করেন চবি পালি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন ও পবিত্র বাইবেল থেতে পাঠ করেন চবি ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কা পিংকি দারিং। আলোচনা সভায় মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে চাকসুর আয়োজনে এবং চবি শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ব্যবস্থাপনায় আন্তঃহল ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
মহান বিজয় দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মসজিদে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্ব স্ব উপাসনালয়ে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া মহান বিজয় দিবসে লাল ব্যাজ ধারণ করা হয়। বিকাল ৩টা থেকে জারুলতলায় শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।







